
ছবিঃ সংগৃহীত
বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিনিয়তই দেশের যুবকেরা বৈধ-অবৈধ পথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সরকার বারবার বিভিন্ন মাধ্যমে বৈধ পথে বিদেশ যেতে উৎসাহিত করলেও এক শ্রেণির দালালের খপ্পরে পড়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বপ্নের দেশে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমান তরুণরা। ভাগ্য সহায় হলে বিভিন্ন দেশের কাঁটাতার ফাঁকি দিয়ে পৌঁছাতে পারেন স্বপ্নের দেশে। আর কারো ভাগ্য সহায় না হলে লাশ ফিরে আসে দেশে, কেউবা ফেরেন নিঃস্ব হয়ে।
এমনই এক ভুক্তভোগী মিলন বিশ্বাস। উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানব পাচারকারী মাফিয়া গ্রুপের প্রলোভনে পড়ে নিজের শেষ সম্বলটুকু দালালের হাতে তুলে দিয়ে পথে পথে ঘুরছেন মিলন বিশ্বাস (৪৫) নামের এক ভুক্তভোগী। তিনি মেহেরপুর সদরের বারাদী গ্রামের বাসিন্দা এবং চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানাধীন খাদিমপুর গ্রামের আলাউদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে।
জানা যায়, ২০২৩ সালে সদর উপজেলার বলিয়ারপুর গ্রামের চান্দালীর ছেলে উজ্জ্বল নামের এক দালালের সঙ্গে কথা হয় মিলন বিশ্বাসের। পানি পথে লিবিয়া থেকে ইতালি নিয়ে যাবে এবং মোটা অঙ্কের বেতনের স্বপ্ন দেখায়। দালালের কথায় মন গলে তার—উন্নত ভবিষ্যৎ কে না চায়? এক পর্যায়ে দালালের কথায় রাজি হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন দুজনে। ১৫ দিনের মধ্যে লিবিয়া থেকেই ইতালি নিয়ে যাবে—এই মর্মে ১০ লাখ টাকায় চুক্তি হয়।
পরবর্তী সময়ে মাফিয়াদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি হয়ে দুবাই যান মিলন বিশ্বাস, সেখান থেকে পৌঁছান লিবিয়ার তব্রুক শহরের এক ‘গেম ঘরে’। সেখানে পৌঁছানোর পরেই উজ্জ্বল ১০ লাখ টাকা আদায় করে নেন।
ওখানে গিয়ে দেখা মেলে মেহেরপুর সদরের কলাডাঙ্গা গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে রুবেল, হান্নানের ছেলে সোহাগ, হাকিমের ছেলে হাসিব, রুহুলের ছেলে হোসাইনসহ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রায় ২০০ জনের সঙ্গে—সকলেই একই পথের যাত্রী। সকলেই পানিপথে ইতালি যাওয়ার আশায় সহায়-সম্বল বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন দালালদের হাতে।
লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর শুরু হয় দালালদের তালবাহানা। ১৫ দিনের কথা বলে সেখানে নিয়ে গেলেও মাসের পর মাস সাহারা মরুভূমির সেই ‘গেম ঘরে’ তাদেরকে আটকিয়ে রাখা হয়।
সেখান থেকে অস্থিসারগ্রস্ত দেহ নিয়ে কোনোরকম প্রাণে ফিরে অবর্ণনীয় নির্যাতনের কাহিনি বলেন মিলন বিশ্বাস। তিনি বলেন, গেম ঘরের অন্ধকার ছোট্ট কামরায় গাদাগাদি করে থাকতে হতো আমাদের। প্রতিটি কক্ষে ১০-১৫ জন ফ্লোরিং করে থাকতাম। তিন বেলা খাবার জুটতো না, অনাহারে-অর্ধাহারে কতদিন কাটিয়েছি তার হিসেব নেই।
সেখান থেকে মাফিয়াদের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলতো, না হলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিত। কারণে-অকারণে মারধর ও শারীরিক নির্যাতন চালাতো। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আবারও বাড়ি থেকে কয়েক দফায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয় মাফিয়াদের হাতে।
পরবর্তীতে তারা ‘গেমে পাঠানোর’ নাম করে নিয়ে গিয়ে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়। পুলিশ সবাইকে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে দেয়। লিবিয়ার বেনগাজি গানফুদা জেলে দুই মাস ছিলাম। সেখানে চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন।
সারাদিনে একবার খুবই অল্প পরিমাণে ভাত খেতে দিত, দুইবার দিত দুই রুটি, ছিল খাবার পানির সংকট। সেখানে নিয়মিত চলতো পুলিশের মারধর, বিদ্যুতের শক ও বুটের লাথি। সেখানকার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। ছোট্ট কামরায় শোয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না গোসলের স্থান। ১৫ দিনেও একবার গোসল হতো না। গরমে অনেকেই চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।
পরবর্তীতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)–এর সহযোগিতায় সকল বন্দিকে মুক্ত করে দেশে পাঠানো হয়।
আমি এক বছর ১০ মাস পর, গত ২৮ মে ২০২৫, কোনোরকম প্রাণ নিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরি। আমি এই সকল দালাল ও মানব পাচারকারী মাফিয়াদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আমার ক্ষতিপূরণসহ সঠিক বিচার চাই।
আর এভাবেই দালাল চক্রের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে হাজারো তরুণের স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পরিবারের বোঝা হয়ে।
প্রসঙ্গত, মানব পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে আইনের পথে হাঁটছেন মিলন বিশ্বাস।
ইমরান