
ছবি:সংগৃহীত
যশোরের অকুতোভয় সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল’র হত্যাকারীরা আড়াই দশকেও চিহ্নিত হলো না। আলোচিত ও লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম পাঁচ বছর মামলার কার্যক্রম চললেও গত ২০ বছর ধরে তা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আইনের মারপ্যাঁচে মামলাটি উচ্চ আদালতে আটকে আছে। উচ্চ আদালতের এই জট ছাড়াতে বারবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ধর্ণা দিয়েও কোনো ফল মেলেনি। প্রথিতযশা এই সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যে দিয়ে আজ (১৬ জুলাই) নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের ২৫তম বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছেন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও স্বজনেরা।
প্রথিতযশা সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল ২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে দৈনিক জনকণ্ঠ যশোর অফিসে কর্মরত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
আদালত সূত্র জানায়, যশোরের অকুতোভয় সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল ২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে খুন হবার পর ২০০১ সালে সিআইডি পুলিশ এই মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। সেই সময় চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকজন আসামি প্রভাব বিস্তার করায় মামলার বর্ধিত তদন্ত করে নতুন করে আসামি করা হয়। একইসাথে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বাদ দিয়ে সাক্ষী করা হয় আসামিদের ঘনিষ্ঠজনদেরকে। এতে একদিকে মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়; অন্যদিকে দুর্বল হয়ে যায় চার্জশিট।
বিতর্কিত ওই বর্ধিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ২০০৫ সালের জুন মাসে যশোরের স্পেশাল জজ আদালতে এই মামলার চার্জ গঠন হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে বাদীর মতামত ছাড়াই মামলাটি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়।
এ অবস্থায় মামলার বাদী, শহীদ শামছুর রহমানের সহধর্মিনী সেলিনা আক্তার লাকি বিচারিক আদালত পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে আপিল করেন।
আপিল আবেদনে তিনি বলেন, মামলার অন্যতম আসামি খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী হিরক পলাতক রয়েছে। হিরকসহ সংশ্লিষ্ট মামলার অন্যান্য আসামিদের সাথে খুলনার সন্ত্রাসীদের সখ্যতা রয়েছে। ফলে তার (বাদী’র) পক্ষে খুলনায় গিয়ে সাক্ষ্য দেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাদীর এই আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ‘মামলাটি কেন যশোরে ফিরিয়ে দেয়া হবে না’ তার জন্য সরকারের উপর রুলনিশি জারি করেন।
এদিকে, মামলায় বর্ধিত তদন্তে সংযুক্ত আসামি ফারাজী আজমল হোসেনও উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। উচ্চ আদালতে রিটের নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলার সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সরকার উদ্যোগ নিয়ে উচ্চ আদালতে বাদীর আপিল এবং ফারাজী আজমল হোসেনের রিট নিষ্পত্তি করলে নিম্ন আদালতে এই মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা না আসলে নিম্ন আদালতে এই মামলার কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করা যাবে না।
উচ্চ আদালতের নির্দেশের কারণে শামছুর রহমান হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ হয়ে আছে উল্লেখ করে যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু জানান, সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল হত্যা মামলাটি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিলের নিষ্পত্তি হলে সেখানে মামলার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। ফলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পেলে খুলনার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
নিহতের সহোদর ও যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে) এর সভাপতি সাজেদ রহমান জানান, বহুবার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে শামছুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য দাবি তোলা হয়েছে। এ নিয়ে বিগত সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রসঙ্গত, এ মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৬ জনের মধ্যে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী মুশফিকুর রহমান হিরক পুলিশের খাতায় পলাতক রয়েছে। আরেক আসামি খুলনার ওয়ার্ড কমিশনার আসাদুজ্জামান লিটু র্যাবের ক্রসফায়ারে, কোটচাঁদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন কালু হৃদরোগে এবং যশোর সদরের চুড়ামনকাটির আনারুল প্রতিপক্ষের হামলায় মারা গেছেন। বাকী আসামিরা জামিনে রয়েছেন। দীর্ঘদিনেও চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির বিচার না হওয়ায় নিহতের পরিবার ও সাংবাদিক সমাজে ক্ষোভ রয়েছে।
এদিকে, শামছুর রহমানের ২৫তম হত্যাবার্ষিকী উপলক্ষে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বুধবার (১৬ জুলাই) যশোরে বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রেসক্লাব যশোর ও যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এদিন সকালে প্রেসক্লাবে জমায়েত হয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এরপর শোকর্যালি করে শহীদের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হবে। পরে প্রেসক্লাবের আয়োজনে দোয়া মাহফিল এবং যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের আয়োজনে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
মারিয়া