
দৈনিক জনকণ্ঠ
রাজশাহী কলেজ—শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, এক বিস্ময়কর প্রজ্ঞার উৎস। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই কলেজ হয়ে উঠেছে জ্ঞান, মনন ও সংস্কৃতির উর্বর ক্ষেত্র।
আর সেই মননের বিকাশে, সাহসী মতপ্রকাশের চর্চায়, সৃজনশীলতার উন্মোচনে যে এক অনন্য মাধ্যম বারবার নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে, তা হলো দেয়ালপত্রিকা। এই দেয়ালিকাগুলো কেবল সাদা কাগজে লেখা কিছু শব্দ নয়, বরং একেকটি দেয়ালিকা যেন সময়ের প্রতিচ্ছবি, প্রজন্মের মুখপত্র। এখানে ফুটে ওঠে তারুণ্যের স্বপ্ন, প্রতিবাদ, ভালোবাসা, সাহিত্য, সমাজচেতনা ও ঐতিহ্যের রং।
রাজশাহী কলেজের দেয়ালিকা সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে হয়ে উঠেছে একটি নীরব বিপ্লবের ভাষা—যেখানে তরুণ কণ্ঠসমূহ শব্দের মাধ্যমে আঁকে তাদের স্বপ্ন, প্রশ্ন তোলে সমাজের সামনে, এবং প্রকাশ করে ব্যক্তিগত অনুভবের গভীরতম স্তর।
শতবর্ষী ভবনের ধূসর দেয়ালে যখন শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা চিত্র, কবিতা, প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গচিত্র ঝুলে পড়ে, তখন তা কেবল একটি পত্রিকা নয়—একটি আন্দোলন, এক সময়ের দলিল, এক মননের উন্মেষ।
এই দেয়ালিকাগুলোর মধ্য দিয়েই রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রথম সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতা অর্জন করে, কেউ প্রকাশ করে তার প্রথম কবিতা, কেউবা সাহস করে তুলে আনে দীর্ঘদিনের অব্যক্ত প্রতিবাদ। এখানেই একজন গল্পকার খুঁজে পায় নিজের ভাষা, একজন চিন্তাশীল নাগরিক খুঁজে পায় মতপ্রকাশের সাহস।
রাজশাহী কলেজ বরাবরই তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন করার মন তৈরি করেছে—এখানকার ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার খাতার বাইরে ভাবতে শেখে, সমাজের বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করে, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার থেকে শুরু করে শিক্ষানীতি—সব বিষয়েই তারা নিজস্ব অবস্থান গড়ে তোলে।
আর এই মতপ্রকাশের সবচেয়ে অকৃত্রিম ও স্বাধীন মঞ্চ হলো দেয়ালিকা। প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব দেয়ালিকা রয়েছে, যেগুলো একেকটি সাহিত্যের ছোট ছোট পরীক্ষাগার। বাংলা বিভাগের দেয়ালিকা যেমন কবিতা ও গল্পের রসে ভরপুর, ইতিহাস বিভাগে থাকে তথ্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ফুটে ওঠে সময়ের তীক্ষ্ণ বাস্তবতা,
ইংরেজি বিভাগে মেলে অনুবাদ সাহিত্য ও গদ্যচর্চার অভিনব রূপ। বিশেষ দিবসগুলোতে যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নববর্ষ কিংবা বসন্তবরণ—তেমন দিনগুলোতে রাজশাহী কলেজের দেয়ালিকাগুলো সেজে ওঠে উৎসবমুখর সাজে। করিডোরজুড়ে তখন শব্দের প্রদর্শনী, চিত্রের বিস্ফোরণ। দেয়ালিকা হয়ে ওঠে তরুণ হৃদয়ের ক্যানভাস।
শিক্ষক সমাজও অনেক ক্ষেত্রে এতে সম্পৃক্ত থাকেন—অনেকে নিজের লেখা দেন, অনেকে আবার শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন এবং দিকনির্দেশনা দেন। এই অভ্যাস শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সংযোগও আরও নিবিড় করে তোলে।
প্রতিটি দেয়ালিকার পেছনে থাকে কিছু নিবেদিত প্রাণ তরুণের শ্রম, সাধনা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। ক্লাস শেষে তারা কেউ পোস্টার ডিজাইন করে, কেউ কবিতার লাইন খোঁজে, কেউ ব্যঙ্গচিত্র আঁকে, কেউ বা লেখক খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় নিজের পকেট খরচ থেকে কিনে আনে কাগজ, রং, স্কচটেপ।
এই নিঃস্বার্থ শ্রমের কোনো প্রচার হয় না, কিন্তু দেয়ালে নিজের লেখা ঝুলতে দেখে যে ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা মোবাইলের স্ক্রিনে শত লাইকেও মেলে না। কিন্তু আফসোস, এই ঐতিহ্যবাহী দেয়ালিকা সংস্কৃতিও আজ এক অস্তিত্ব সংকটে।
ডিজিটাল দুনিয়ার আকর্ষণ, অনলাইন মাধ্যমে লেখার সহজলভ্যতা, অনীহা, সময় সংকট, অর্থাভাব, এবং প্রশাসনের পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব—সব মিলিয়ে এই শিল্প ও সাহিত্যচর্চার প্রাণপ্রবাহ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ছে। অনেক বিভাগেই আর নিয়মিত দেয়ালিকা প্রকাশ হয় না, কিছু বিভাগের দেয়ালিকা একেবারেই নিস্তেজ। অথচ রাজশাহী কলেজের মতো একটি প্রতিষ্ঠান চাইলে এই ঐতিহ্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে।
প্রশাসন চাইলে প্রতিবছর “দেয়ালপত্রিকা উৎসব” আয়োজন করতে পারে, যেখানে প্রতিটি বিভাগের দেয়ালিকা প্রদর্শনের সুযোগ পাবে। সেরা লেখক, সম্পাদক, চিত্রকরদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে।
শিক্ষকদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করা যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে দেয়ালিকার গুরুত্ব বোঝাতে কর্মশালা বা প্রশিক্ষণও দেওয়া যেতে পারে। রাজশাহী কলেজের দেয়ালপত্রিকাগুলো কেবল কিছু লেখা বা ছবি নয়—এগুলো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আত্মার প্রতিধ্বনি।
এই দেয়ালে আঁকা প্রতিটি শব্দ ভবিষ্যতের দিক চিহ্ন। এখানেই লুকিয়ে থাকে কারো প্রথম কবিতা, কারো প্রথম প্রতিবাদ, কারো প্রথম চেতনার বিস্ফোরণ। এই দেয়ালিকাগুলোই একদিন জন্ম দেয় দেশসেরা লেখক, সাংবাদিক, গবেষক বা বুদ্ধিজীবীর। কারণ রাজশাহী কলেজ কেবল ক্লাসরুম নয়—এটি এক জীবন্ত চিন্তার চারণভূমি, যেখানে দেয়ালও কথা বলে, দেয়ালও শেখায়, দেয়ালও লড়াই করে।
তাই যতদিন রাজশাহী কলেজের করিডোরে শিক্ষার্থীদের লেখা ঝুলে থাকবে, ততদিন এই প্রতিষ্ঠান শুধু পাঠদানে নয়, বরং চিন্তা, চেতনা ও পরিবর্তনের নেতৃত্বে থাকবে—এই প্রত্যয় নিয়েই রাজশাহী কলেজ তার শিক্ষার্থীদের দিয়ে যাচ্ছে এক সাহসী, সৃজনশীল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।
হ্যাপী