ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

জোবায়েরের গল্প, তেরখাদার ভাঙা ঘরে আলো হয়ে থাকা এক সন্তানের বিদায়

আমির ফয়সাল, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ১১ জুলাই ২০২৫

জোবায়েরের গল্প, তেরখাদার ভাঙা ঘরে আলো হয়ে থাকা এক সন্তানের বিদায়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটা মারা গেল; জোবায়ের, ওর বাসায় গিয়েছিলাম। খুলনার তেরখাদাতে ওদের বাসা। যে মা মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন সেই মায়ের সাথে কথা হয়েছে। 

জোবায়েরের জীবন ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামের ছিল। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় ওর হিমোফেলিয়া রোগ ধরা পড়ে। আনাড়ি এক ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় পঙ্গু হয়ে যায় জোবায়ের। সবাই ডাক্তারের নামে মামলা দিতে চেয়েছিল। জোবায়ের মামলা করতে দেয়নি। জোবায়েরের কথা ছিল, “ আমার যা হওয়ার হয়েছে, ডাক্তারের নামে মামলা দিলে তো আর আমি পা ফিরে পাবো না।”
জোবায়েরের জীবন হয় হুইল চেয়ারের জীবন। 

জোবায়েরের মা মানুষের বাসায় কাজ করে তার পড়ালেখা চালিয়ে নেয়। এ সময় জোবায়ের নিজেও মুদির দোকানে কাজ করে। 

স্কুল জীবন শেষ করে জোবায়ের যখন কলেজে ভর্তি হবে, মা নিরুপায় হয়ে জানায়, কলেজে আসা-যাওয়া করতে প্রতিদিন যে ৩০ টাকা করে লাগবে, মা আর সেই টাকা দিতে পারবে না। 
জোবায়েরের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তেরখাদার মানুষের ভালবাসায় পড়ালেখা থামে না। জোবায়েরের শিক্ষকরা প্রতিদিন কলেজে আসা-যাওয়ার খরচ ম্যানেজ করে দেন। 

একদিন কলেজ থেকে আসার পথে জোবায়েরের পঙ্গু পায়েই আবার অ্যাকসিডেন্ট হয়।
ছেঁড়া পাল আবার ছিঁড়ে যায়! 

সেই পায়ের চিকিৎসার সূত্র ধরেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের মহৎ প্রাণ এক ডাক্তারের সাথে জোবায়েরের পরিচয় হয় ( এই ডাক্তারের নামটা বের করতে পারিনি, কেউ যদি উনার নাম-পরিচয় জানাতে পারেন কৃতজ্ঞ থাকবো)। ডাক্তার ভালবেসে জোবায়েরকে আপন করে নিয়েছিলেন। পড়ালেখায় যেমন উৎসাহ দিতেন তেমনি আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করতেন। 

এরমধ্যে এইচ এস সি পাশ করে জোবায়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। ঢাকায় গিয়ে থাকা, কোচিং করা, অনেক টাকার ব্যাপার, সাথে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। 
এগিয়ে আসলেন জোবায়েরের কলেজ শিক্ষকেরা , মামাতো, খালাতো ভাইয়েরা। এগিয়ে আসলেন অচেনা সেই ডাক্তার। ডাক্তারের পরামর্শেই জোাবায়ের ভর্তি হয় ইউসিসিতে। কিছুদিন ডাক্তারের বাসাতেও ছিল জোবায়ের। 

ইউসিসির পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী স্যার সব শুনে সম্পূর্ণ ফ্রিতে জোবায়েরকে ভর্তি করে নিলেন । হোস্টেলে বিনা পয়সায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন । সবাইকে অর্ডার করে দিলেন, জোবায়েরকে যেন সবাই সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। 

শিক্ষকরা ভীষণ ভালবেসে জোাবয়েরকে আপন করে নেয়। জোবায়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। বারবার ঝড় মোকাবেলা করে যে গাছটা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ এক ঝড়ে সেই গাছটা পড়ে গেল! এক রাতের ব্যবধানে অসুস্থ হয়ে, কাউকে কোন সেবা করার সুযোগ না দিয়েই জোবায়ের চলে যায়। জোবায়েরের সংগ্রামী জীবন মাঝপথে এসে থেমে যায়। 
ছেঁড়া পাল আবার ছিঁড়ে যায়! 

জোাবয়েরের লাশ যখন গ্রামে গেল, পুরো তেরখাদার মানুষ চিৎকার করে কেঁদেছে। যে মানুষটার চোখে কেউ কখনো পানি দেখেনি সেই মানুষটাও জোবায়েরের নিথর দেহটা দেখে আকাশ ভারী করে কেঁদেছে! 

জোবায়েরের বৃদ্ধা মা একমাত্র সন্তানের লাশ সামনে রেখে বারবার বলছিল, “ও বাজান, আমার পাখি কি কিছু কয়ে গেছে? আমার কথা কিছু কয় নাই? আমি এখন কী করবো! তোমরা কিছু বলো, ও বাজান তোমরা কিছু কচ্ছোনা কেনো?”

জোবায়েরের মায়ের একটাই সন্তান ছিল। ছেলে হারিয়ে মা আজ পাগলপ্রায়! 

”আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা
ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে
হাত বাড়াইয়া ডাকে”

এই বৃদ্ধা মায়ের ভাঙ্গা ঘরের, ভাঙ্গা চালার জোছনা ছিল জোাবয়ের। যেনতেন জোছনা না, “ অবাক জোছনা”।বৃদ্ধা মাকে সান্তনা দিয়েছি। অক্ষমের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেছি, কিন্তু সেটা নিঃস্ব এক মায়ের জন্য খুবই অপ্রতুল। 

ক্রাউড ফান্ডিং বাদ দিয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু আরেকটাবার ক্রাউড ফান্ডিং করবো জোবায়েরের মায়ের জন্য। জোবায়েরের মাকে কয়েকটা গাভী কিনে দিবো অথবা একটা দোকান করে দেয়ার নিয়ত করেছি। যারা নিজেদের নিঃস্ব এক বৃদ্ধা মায়ের সন্তান “জোবায়ের” ভেবে মাকে সাহায্য করতে আগ্রহী তারা নক দিবেন।বৃদ্ধা মাকে কথা দিয়েছি,” আপনি চিন্তা করবেন না মা, আপনার অসংখ্য জোবায়ের আছে। “

আঁখি

আরো পড়ুন  

×