
ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সম্পৃক্ততা দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি কিম জং উন রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক জোটের এক বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে উত্তর কোরিয়ার একাধিক নিহত সেনার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওইসব সেনারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়।
পিয়ংইয়ংয়ের এক থিয়েটারে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে কফিনে মোড়ানো লাশের সামনে কিম জং উনের কান্নার ছবি দেখানো হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া মিত্রতার এক নতুন ও দৃঢ় অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্লেষক ওলেগ ইগনাতভ জানিয়েছেন, “উত্তর কোরিয়া এখন রাশিয়ার জন্য ইরান বা চীনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। তারা গোলাবারুদ ও কিছু ভারী অস্ত্র সরবরাহ করছে। শুরুতে উত্তর কোরিয়ান সেনারা আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ ছিল না, তবে তারা দ্রুত অভিযোজিত হয়েছে।”
ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়া শিগগিরই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সেনা সংখ্যা তিন গুণ বাড়াতে যাচ্ছে। প্রায় ৩০,০০০ অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে প্রায় ১৫,০০০ সেনা কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধ করেছে।
রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনা ও বিবিসির হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১৬,০০০ এরও বেশি সেনা নিহত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত জনবল রাশিয়ার জন্য একটি বড় সহায়তা।
বিশেষজ্ঞ র্যাচেল মিনইয়ং লি বলেন, “উত্তর কোরিয়ার সেনারা এখন আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার নেই। পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল, গম ও সামরিক প্রযুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এসব কারণেই কিম জং উনের যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।”
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হয়েছে। রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া সীমান্তে কাসান-টুমেন রেললাইন দিয়ে আবারও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। রাশিয়া থেকে কয়লা, সার ও লোহা যাচ্ছে; বিপরীতে উত্তর কোরিয়া থেকে সামুদ্রিক খাবার ও দুর্লভ খনিজ পদার্থ আসছে। রাজিন বন্দরের আধুনিকীকরণেও রাশিয়া সহায়তা করছে, যাতে এটি দক্ষিণ কোরিয়ার বিকল্প একটি বন্দর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় গঠিত উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে সোভিয়েত পতনের পর সেই সম্পর্ক শিথিল হয়। রাশিয়া তখন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞায় অংশ নিয়ে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল।
কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। উত্তর কোরিয়া তখনই জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এরপর রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু উত্তর কোরিয়া সফর করেন এবং কিম জং উন রাশিয়ায় গিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২০২৪ সালের জুনে পুতিন ও কিম যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, এক পক্ষ যদি বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হয়, তাহলে অন্য পক্ষ সামরিক ও অন্যান্য সহায়তা দিতে পারবে। এই ধারার আওতায় উত্তর কোরিয়ার সেনা পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।
প্রথমে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া উভয়ই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি গোপন রাখে। তবে পরে তা স্বীকার করে। কুরস্কে নিহত উত্তর কোরিয়ান সেনাদের সম্মানে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও সড়কের নামকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়া।
রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিওদর ক্রাশেনিনিকভ মনে করেন, শুরুতে গোপনীয়তার অনুরোধ করেছিল উত্তর কোরিয়া, কারণ তারা নিজেদের প্রচারণায় বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপন করবে, তা নিয়ে ভাবছিল। যখন তারা উপযুক্ত বার্তা তৈরিতে প্রস্তুত হয়, তখনই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।
এই মিত্রতা যে শুধু সাময়িক সুবিধা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলতে পারে— তা বলছেন অনেক পর্যবেক্ষক। উত্তর কোরিয়ার কৌশলগত গুরুত্ব রাশিয়ার কাছে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.