ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

শেরপুরের মমিনবাগ বাড়ি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিদর্শন

সাফিজল হক তানভীর, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শেরপুর

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৭ জুলাই ২০২৫

শেরপুরের মমিনবাগ বাড়ি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিদর্শন

শেরপুরের মমিনবাগ বাড়ি

শেরপুর শহরের গৌরীপুর এলাকায় অবস্থিত মমিনবাগ নামক বাড়িটি কেবল একটি আবাসিক স্থাপনা নয়, এটি শেরপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্যের একটি জীবন্ত স্মারক। এই বাড়ির পেছনে রয়েছে শতাব্দীর প্রাচীন ইতিহাস, ভিন্নধর্মী বসবাসের সহাবস্থান, দেশভাগের প্রেক্ষাপট এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

প্রাচীনকালে শেরপুর অঞ্চলে বসবাস করতেন ভূঁইয়ারা, যারা ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদার শ্রেণির মানুষ। ধারণা করা হয়, দেশ ভাগ ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়, সেই ভূঁইয়া পরিবার শেরপুর ছেড়ে ভারতে চলে যান। দেশত্যাগের সময় তাঁরা তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি স্থানীয় এক হিন্দু প্রজার কাছে স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করে যান। সেই হিন্দু পরিবারের কাছ থেকেই ১৯৭৭ সালে শেরপুরের একজন স্থানীয় মুসলিম ব্যক্তি, মোঃ উসমান গণী, সম্পূর্ণ বাড়িটি বৈধভাবে ক্রয় করেন।

ক্রয় করার পর উসমান গণী শুধু এই বাড়ির মালিক হননি, বরং তিনি এটিকে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে একটি ঐতিহ্যবাহী ও মনোরম স্থানে পরিণত করেন। তিনি বাড়ির পুরনো দালানগুলোর গঠন রক্ষা করে নতুনভাবে সংস্কার করেন, বাড়ির চারপাশে নানাবিধ গাছপালা, ফুলের বাগান এবং খোলা জায়গা তৈরি করে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তোলেন। বাড়ির প্রবেশপথের পাশে অবস্থিত একটি প্রাচীন দীঘি, যার মিঠা পানি ও পাকা ঘাট আজও দর্শনার্থীদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই বাড়ির নাম মমিনবাগ পূর্বে ছিল না। উসমান গণীর একজন আস্থাভাজন সহচর ছিলেন মমিন সাহেব, যিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক গুণে বলীয়ান এবং নীতিবান একজন ব্যক্তি। তাঁকে ঘিরেই এই বাড়ির নামকরণ করা হয় মমিনবাগ’। বর্তমানে এটি নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে এবং স্থানীয় জনগণের কাছে এক পরিচিত স্থান।

মমিনবাগ বাড়িটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষ্যই বহন করে না, এটি এখনো শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে খানিকটা দূরে এক শান্ত, মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অবস্থিত। নানা প্রজাতির গোলাপ ফুলের সমাহার, সুপরিসর উঠান, দীঘি ও বাগান সবমিলিয়ে এটি একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। যারা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রকৃতির মিশ্রণে সৌন্দর্য খুঁজে পেতে চান, তাদের জন্য মমিনবাগ হতে পারে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য।

শেরপুর শহরের থানা মোড় বা নিউমার্কেট এলাকা থেকে সোনার বাংলা নতুন বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার পথে ডান দিকে গৌরীপুর এলাকাতেই এই বাড়িটির অবস্থান। সহজে যাতায়াতযোগ্য হওয়ায় এটি আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনক।

বর্তমানে উসমান গণীর উত্তরসূরিরাই বাড়িটির দেখাশোনা করছেন। তাদেরও প্রত্যাশা, এই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিবেচনায় রেখে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে এটি শেরপুরের গুরুত্বপূর্ণ একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।

মমিনবাগ একটি নিছক বাড়ি নয়, এটি শেরপুরের ইতিহাস, সামাজিক সহাবস্থান, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সংস্কার ও সংরক্ষণের এক অনন্য প্রতীক। স্থানীয় প্রশাসনের সামান্য সহযোগিতা এবং পর্যটন দপ্তরের দৃষ্টি পড়লেই এই স্থাপনাটি হয়ে উঠতে পারে শেরপুর শহরের গর্ব।

তাসমিম

×