
ছবি: সংগৃহীত
ডেঙ্গু একসময় নগরকেন্দ্রিক একটি মৌসুমী রোগ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন এই রোগ শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এর ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরগুনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। গত কয়েক সপ্তাহে বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিলও। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ধূপতি মনসাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শিরিন সুলতানার (৪৫)। তিনি বরগুনা বিআরডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিনের স্ত্রী এবং তিন সন্তানের জননী। মৃত্যুর সময় তিনি বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই হৃদয়বিদারক মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে শোকাহত করেনি, পুরো এলাকাকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।
শিরিন সুলতানার মৃত্যু বরগুনা জেলার ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করা ৩৫তম ঘটনা। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরগুনা সদরেই মারা গেছেন ২৮ জন, বেতাগী উপজেলায় ৪ জন এবং পাথরঘাটায় ৩ জন। এসব তথ্য শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি করুণ মানবিক গল্প, একটি পরিবারে দীর্ঘস্থায়ী শোক।
ভয়াবহ চিত্র প্রতিদিন হাসপাতালগুলোতে
বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিনই নতুন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৭১ জন। জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৩ জনে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ১৯৩ জন, যার মধ্যে ১৩৮ জনই বরগুনা সদর হাসপাতালে।
এই পরিসংখ্যান যথেষ্ট নয় বরগুনার চিত্র বুঝতে। বাস্তবতা হলো—হাসপাতালগুলোতে বেড নেই, স্যালাইন ও রক্তের ঘাটতি রয়েছে, চিকিৎসক ও নার্সরা হাঁপিয়ে উঠেছেন। রোগীর স্বজনরা দিশেহারা। অনেকে বরিশাল, ঢাকা অথবা খুলনায় রেফার হচ্ছেন, আবার অনেকেই মৃত্যুর আগে সেই সুযোগটুকুও পাচ্ছেন না।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা কেন?
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পেছনে দায় এড়াতে পারে না কেউই। স্থানীয় প্রশাসন, পৌরসভা, স্বাস্থ্য বিভাগ—সবাই বর্ষার আগেই জানতেন যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সময়মতো মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়নি, হয়নি ঘরবাড়ি ও ড্রেন পরিষ্কার করার কার্যকর ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও তো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাও হয়নি। জনসচেতনতা কর্মসূচি ছিল দায়সারা। বরগুনা পৌরসভার ভেতরেই বহু এলাকায় এখনো জলাবদ্ধতা ও অপরিষ্কার পরিবেশ ডেঙ্গু বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—মশার বিস্তার রোধ। কিন্তু এটিই যদি নিশ্চিত না হয়, তবে হাসপাতাল বাড়িয়ে, ওষুধ দিয়ে, চিকিৎসক পাঠিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে কী করণীয়?
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনই নিতে হবে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো:
১. জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও অতিরিক্ত বরাদ্দ: বরগুনাকে ডেঙ্গুপ্রবণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করে এখানে বিশেষ স্বাস্থ্যঝুঁকি ঘোষণা দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাড়তি মেডিকেল টিম ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
২. মশক নিধনে ব্যাপক অভিযান: প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় প্রতিদিন মশক নিধন অভিযান চালাতে হবে। লার্ভা ধ্বংসে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি জমে থাকা পানি ও নোংরা জায়গা শনাক্ত করে তা পরিষ্কার করতে হবে।
৩. জনসচেতনতা বাড়ানো: স্কুল, কলেজ, মসজিদ, বাজার, অফিসে প্রচারণা চালাতে হবে। কীভাবে ডেঙ্গু ছড়ায়, প্রতিরোধে কী করণীয়—এ নিয়ে লিফলেট, মাইকিং ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে।
৪. স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন: ছাত্র, যুবক ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে প্রতিটি এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে। সরকার এ উদ্যোগকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারে।
৫. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি নিশ্চিত: ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর প্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডেঙ্গু এখন আর শুধুমাত্র একটি রোগ নয়, এটি একটি সামাজিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। একটি মা, একজন শিক্ষিকা, তিন সন্তানের জন্য আশ্রয় হয়ে থাকা শিরিন সুলতানার মৃত্যু ছাড়াও ডেঙ্গুতে আরো অনেকর মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বরগুনার প্রতিটি ঘরে এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক। আর এই আতঙ্ক যদি সচেতনতা, প্রতিরোধ ও মানবিক উদ্যোগে রূপ না নেয়, তবে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে আরও অনেক মৃত্যুর খবর।
এখনই সময়, নিজের ঘর থেকে শুরু করে গোটা সমাজে সচেতনতার আগুন ছড়িয়ে দিতে। এখনই সময়, দোষারোপ নয়, বরং সম্মিলিতভাবে কাজ করার। কারণ, ডেঙ্গু কারো ঘর চেনে না, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা আর সচেতনতা মশার চক্রকে থামাতে পারে।
আবির