ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

ত্রিপুরা মহারাজার ’কাছারি বাড়ি’

আবুল ফজল মোঃ আবদুল হাই, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৮ জুলাই ২০২৫

ত্রিপুরা মহারাজার ’কাছারি বাড়ি’

দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ ও পর্যটন নগরী মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে রক্ষণাবেক্ষণ আর সংস্কারের অভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরা মহারাজার স্মৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক ত্রিপুরা মহারাজার ‘কাছারি বাড়ি’। শ্রীমঙ্গল শহরের প্রাণকেন্দ্র হবিগঞ্জ রোড (ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক)-এর ভূমি অফিসের পাশে অবস্থিত এই স্থাপনা।

শতবর্ষী এই ভবনটি একসময় লোকে লোকারণ্য ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে খাজনা দিতে আসতেন। সেই খাজনা যুগের অবসান হয়েছে বহু বছর আগে। এখন খাজনা যুগের স্মৃতি ধারণ করে নীরবে ভগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯৭ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা মহারাজা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য শহরের মধ্যভাগে প্রায় দেড় বিঘা জমির ওপর চুন-সুরকি দিয়ে কাছারি বাড়িটি নির্মাণ করেন। সম্প্রতি ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভূমি অফিসের সীমানার ভেতরে অবস্থিত কাছারি বাড়িটির পাশেই রয়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভূমি অফিস, শানবাঁধানো ঘাটসহ একটি বিশাল পুকুর। কাছারি বাড়ির নাম অনুসারে নির্মিত হয়েছে কাছারি জামে মসজিদ।

শতাধিক বছরের পুরোনো এই কাছারি বাড়িটি ১ দশমিক ৬৭ একর জায়গার ওপর নির্মিত। একতলা কাছারি বাড়িটি প্রস্থে ৩০ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে ২০ ফুট। ভবনে রয়েছে ৩টি কক্ষ, ৮টি দরজা এবং ৯টি জানালা। ১২ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল ও চুন-সুরকির কারুকাজ আজও চোখে পড়ে।

অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে এই স্থাপনা। বাড়ির ছাদের পলেস্তরা ভেঙে পড়ছে, দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঘরের মেঝেতে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। মূল রঙের কোনো ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। দরজা-জানালা সবই চুরি হয়ে গেছে। ভবনের বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে— “ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত শুটিং/ভিডিও ধারণ নিষিদ্ধ, আদেশক্রমে- কর্তৃপক্ষ।”

স্থানীয়রা জানান, শ্রীমঙ্গল একটি পর্যটন নগরী। ইতোমধ্যে এর সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ত্রিপুরা মহারাজার ঐতিহ্যবাহী কাছারি বাড়িটি সংস্কার করলে নতুন প্রজন্ম এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা এই নিদর্শন দেখতে পারবে।

শ্যামল দেববর্মা বলেন, “শ্রীমঙ্গল একসময় ত্রিপুরার অধীনে ছিল। তখন ত্রিপুরাদের সংখ্যা ছিল অনেক। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বেশিরভাগ ত্রিপুরা ভারত চলে যায়। ত্রিপুরা মহারাজার কাছারি বাড়িতে বসেই অষ্টাদশ শতকে ত্রিপুরা মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্য প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহারাজ মানিক্য বাহাদুর দেববর্মা সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম আগরতলায় সরিয়ে নেন।”

ত্রিপুরা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছে বৃহত্তর সিলেট ত্রিপুরা উন্নয়ন পরিষদ। জানা যায়, এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে।

সুমন দেববর্মা জানান, “২০১৬ সালের জুন মাসে তৎকালীন শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ নুরুল হুদা কাছারি বাড়িটি সংস্কার করে নতুন রঙের কাজ করান। কিন্তু পরে কাজের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।”

শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ এহছানুল হক বলেন, “ত্রিপুরা মহারাজার তৈরি এই কাছারি বাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এর কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে সংস্কার করলে ভবনটি সংরক্ষিত থাকতো। এটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।”

শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “আমি নতুন এসেছি। খোঁজ নিয়ে দেখব আমার পূর্ববর্তী সহকারী কমিশনার কোনো পরিকল্পনার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন কিনা। এরপর সংরক্ষণ বা পুনঃসংস্কারের বিষয়ে জানাতে পারব।”

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসলাম উদ্দিন বলেন, “সংরক্ষণ বা পুনঃসংস্কারের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

মিমিয়া

×