
এক সময় ছিল যাদুকরী এক বাক্স, নাম তার ভিসিয়ার (VCR)। রাত নামলেই শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলের কোনো বাড়িতে বসতো ‘ছবির মেলা’। আজ সেই ভিসিয়ার ঠাকুরগাঁও জেলার স্মৃতি জুড়ে শুধুই গল্প হয়ে রয়ে গেছে।
৯০-এর দশক থেকে ২০০০ সালের শুরুর দিকে ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক বাড়িতে, বিশেষ করে প্রবাসী পরিবারগুলোর ঘরে, পাওয়া যেত এই যন্ত্রটি। কেউ কেউ ভাড়া এনে পুরো মহল্লাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসাতেন “ইংরেজি মুভির নাইট শো”। আবার ঈদের দিন, বিয়ের সময় বা অতিথি এলে বিশেষ ছবি চালিয়ে বসতো ভিসিয়ার, দৃশ্যটা তখনকার বিনোদনের রাজা।
সেই সময়কার বেশ কিছু দোকান ছিল যেখানে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেওয়া হতো। ঠাকুরগাঁও শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড ও পীরগঞ্জ বাজারের এমন দু-তিনটি দোকানের নাম এখনও স্থানীয় প্রবীণরা মনে রেখেছেন। ভিসিয়ার থাকলে সঙ্গে থাকতো “টিভির উপরে আলাদা অ্যাডাপ্টার”, রিমোটের বদলে অনেক সময় স্ক্রু ড্রাইভার দিয়েই চালু হতো মেশিন।
এখন সেই ক্যাসেট? সেই যন্ত্র? আর নেই। নতুন প্রজন্ম তো VCR শব্দটাই বোঝে না। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আর স্মার্টফোনের যুগে সেই ঘরোয়া “সিনেমা হল” যেন ভূতের গল্প।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রবীণ শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম (৭২) বলেন, “আমার ছেলের বিয়েতে ভিসিয়ার ভাড়া করে ছবি দেখিয়েছিলাম। এখনও লোকজন বলে সেই বিয়ের রাতের কথা। অথচ সেই যন্ত্রটাই এখন সবার ভুলে যাওয়া ইতিহাস।”
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও গ্রামের ব্যবসায়ী ওয়াহেদ আলী (৬২) বলেন, “ঈদের পরদিন এক প্রবাসী বন্ধুর বাসায় ভিসিয়ারে ছবি দেখার জন্য আমরা ৩২ জন মিলে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়েছিলাম। ওই রাতে যেভাবে সবাই মিলে হেসে-খেলে সিনেমা দেখছিলাম সেই অনুভূতিটা আজও ভাবায়।”
আজ যদি কেউ পুরনো ভিসিয়ার চালাতে চায়, সেই ক্যাসেটই আর পাওয়া যাবে না। আর যদি কোথাও অক্ষত ভিসিয়ার থাকে, সেটিও হয়তো এক কোণে পড়ে থাকা মৃত যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।
এক সময়ের আবেগ, হাসি, রোমাঞ্চ আর পারিবারিক মিলনের প্রতীক ছিল যে যন্ত্রটি, সেই ভিসিয়ার আজ শুধুই স্মৃতির অংশ। ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাসে এই হারিয়ে যাওয়া মাধ্যমটি যেন প্রযুক্তির দ্রুতগতির পথে পেছনে ফেলে আসা এক নিঃশব্দ প্রস্থান।
“ভবিষ্যতের কোনো জাদুঘরে হয়তো একদিন ঠাকুরগাঁওয়ের ভিসিয়ারও থাকবে, একটি বোতাম টিপলেই ফিরে আসবে সেই হারানো দিনের গল্প।”
মিমিয়া