
ছবি: জনকণ্ঠ
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি হারানো আশ্রয়হারা হতদরিদ্র মানুষের গৃহ পুনর্বাসনে সরকারিভাবে নির্মিত গামুরিবুনিয়া আবাসনের ১০টি ব্যারাকের এক শ’ কক্ষের চরম বেহাল দশা। অর্ধেক ঘর খালি অবস্থায় পড়ে আছে। আশ্রিতরা নেই। ঘরগুলো বেড়া, চালের টিন উধাও। আয়রণের স্ট্রাকচার পড়ে আছে। সেসব পরিবারগুলো এখনও থাকছেন তাদের চলছে মানবেতর জীবন-যাপন। চালের সব টিন জং ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে বাইরের আগে ঘরে পানি পড়েছে। ভিজে যায় বিছানাপত্র থেকে শুরু করে ঘরের মালামাল। পলিথিন টানিয়েও শেষ রক্ষা হয না। সিমেন্টের খুটিগুলো ধসে গেছে। টয়লেট নেই। নেই রান্নাঘর। এসব দরিদ্র মানুষগুলোর এখন চরম দুরবস্থা চলছে। করছেন মানবেতর জীবনযাপন। শুধুমাত্র সরকারের যথাযথ তদারকির অভাবে দরিদ্র অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করার সরকারের এই যুগান্তকারী উদ্যোগ এখন ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যেন দরিদ্রদের গৃহপুনর্বাসন প্রক্রিয়াটির কোন মনিটরিং ব্যবস্থাই নেই।
অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলো এখন যারা আবাসনে থাকছেন তাদের অন্যত্র কোন যাওয়ার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে থাকছেন। কাটাচ্ছেন উপোস কিংবা অর্ধাহারে একেকটা দিন। সরকারের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা থেকেও এসব মানুষগুলো সবসময় উপেক্ষিত থাকছেন। এদের জীর্ণদশার ঘরগুলো দ্রুত মেরামত করা না হলে এরা আবার ঠিকানা হারা হয়ে পড়বেন তারা। মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানকার গৃহপুনর্বাসিত ১০০ দরিদ্র অসহায় পরিবারের যারা এখনও আছেন তারা মানবিক বিবেচনায় ঘরগুলো মেরামত করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। কারণ সারাদিন শ্রম বিক্রি করে সন্তানসন্ততি নিয়ে রাতের বেলা একটু স্বস্তিতে ঘুমানোর মতো সুযোগ মিলছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরি বুনিয়ায় ২০০৮ সালে এক শ’ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১০টি টিনশেড ব্যারাক করে দেওয়া হয়। মনোরম পরিবেশ। ইউ টাইপে তিনদিকে ব্যারাক হাউস করা হয়েছিল। মাঝখানে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। দক্ষিণ দিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার ছিল। যেখানে আবাসনে বসবাসকারীদের শিশুরা লেখাপড়া করার সুযোগ সুষ্টি করা হয়েছিল। করা হয়েছিল কমিউনিটি সেন্টার ভবন। পুকুরটিতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সব বেহালদশা। যেন সব ব্যারাকগুলো জীর্ণদশার বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
তিন নম্বর ব্যারাকের ছয় নম্বর ঘরের বাসিন্দা চার সন্তানের জননী পিয়ারা বেগম জানালেন, ঘরের চাল নাই। পলিথিন টানাইয়া থাকি। সিমেন্টের খুটি খুইল্যা পড়ে। বৃষ্টিতে বাইরের আগে ঘরে পানি পড়ে। দরজা-বেড়া ভাঙ্গা। ল্যাট্রিন নাই। খাবার পানি বাইরে থেকে আনতে হয়। স্বামী ভাড়াটে অটোচালক রাসেলের একার উপার্জনে খেয়ে না খেয়ে দিন চলছে তাদের। আজ বৃহস্পবিার সকালে পান্তাভাত আর পোড়া মরিচ দিয়ে সন্তানদের নিয়ে খেতে হয়েছে বলে জানালেন। জীবনের দূরবস্থায় এখন কাহিল পিয়ারা। জানালেন, ষষ্ঠশ্রেনী পড়ুয়া নাজমুন নাহার সুমাইয়া সাত কিলোমিটার দূরে কলাপাড়া শহরের গার্লস স্কুলে হেঁটে যায়। বাপের সুযোগ থাকলে কখনো অটোতে যাইতে পারে। নইলে ভোগান্তির শেষ নাই। একটা স্কুল ব্যাগ নাই। নাই একটা গাইড বই। একই দশা ফাইভে পড়া ফারিয়ার। যেন দূঃখ কষ্টের জীবনে স্বস্তিটুকুও নেই পিয়ারার। ১৪টি বছরের দশটি বছরই এভাবে কাটছে তার। ঘরটি মেরামত করার জন্য একটু আকুতি পিয়ারার। থাকার কোন জায়গা না থাকায় উপায় না পেয়ে অসহনীয় কষ্টে কাটাচ্ছেন পিয়ারা বেগম।
১০ নম্বর ব্যারাকের সাত নম্বর ঘরের বিধবা শেফালী রাণী জানালেন, ৬০ হাজার টাকার এনজিও লোনের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা কর্জ করে ঘরের চাল কিছুটা ঠিক করেছেন। কোন উপায় নাই তাই এখনও এখানে থাকছেন। আট নম্বর ব্যারাকের ১০ কক্ষের মর্জিনা বেগমও জানালেন, একই কষ্টের কথা। যেন দুঃখের সাতকাহন এসব হতদরিদ্রদের। দুই নম্বর ব্যারাকের নয় নম্বর কক্ষের ৯৮ বছর বয়সী কাছেম হাওলাদার এখন শয্যাশায়ী। জানালেন দরাজ কন্ঠে- চালে পলিথিন দিয়াও থাকতে পারি না। বাবা একটা কিছু করেন। একমাত্র কিশোর বয়সী ছেলে নাঈমের উপার্জনের ওপর নির্ভর থাকা বয়োবৃদ্ধ এ মানুষটি জানালেন, তাদের ঘরটি মেরামত কেউ করতে পারেব না ? একই আবেদন ৯০ বছর বয়সী আশের্^দ হাওলাদারের। চার নম্বর ব্যারাকের আট নম্বর কক্ষের এই মানুষটিও এখন শয্যাশায়ী। তিন বেলা খাবার তো দূরের কথা চিকিৎসাও চলে না। মানুষটির দুর্দশার যেন শেষ নেই। বয়স্ক ভাতাও জোটেনি তার। গোটা ব্যরাক হাউসগুলোর বাসীন্দাদের কষ্টের ধরন এক। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ কেউ তাঁদের খোঁজ-খবর নেয় না বলে ক্ষুব্ধ মনোভাব পোষণ করলেন সবাই। ৬ নম্বর ব্যরাকের আটটি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেড়ার টিন উধাও হয়ে গেছে এসব কক্ষের। এই ব্যরাকের তিনটি কক্ষ বিধ্বস্ত দশায় রয়েছে। ময়লা আবর্জনায় একাকার হয়ে আছে। আগে গরু থাকত।
এভাবে ৬নম্বর ব্যারাকের ৪টি। ৭ নম্বর ব্যারাকের ৪টি। ৮ নম্বর ব্যারাকের ৩টি। ৯ নম্বর ব্যারাকের ২টি। ১০ নম্বর ব্যারাকের ২টি। ৫ নম্বর ব্যারাকের ৬টি। তিন নম্বর ব্যারাকের ৫টি। দুই নম্বর ব্যারাকের ৬টি। এক নম্বর ব্যারাকের ২টি কক্ষ খালি রয়েছে। এছাড়া অন্তত আরও ১৬টি কক্ষের চাল বেড়া নেই। উপরের আয়রন স্ট্রাকচার কঙ্কালের মতো পড়ে আছে। এভাবে ১০টি ব্যরাকের অন্তত অর্ধেক কক্ষ এখন আর আবাসনটিতে ব্যবহৃত হয় না। এর মধ্যে আবার অনেকে খালি পজিশন দখলে রেখেছে। এক নম্বর ব্যারাকের সেরাজ হাওলাদার ঘর পাওয়ার দুই বছর পরই অন্যত্র (পূর্ব চাকামইয়া) চলে গেছেন। কিন্তু এখনও খালি স্ট্রাকচার তার দাবি করে অন্য কাউকে থাকতে দিচ্ছেন না। এসব মানুষের সকলের দাবি জীর্ণদশার ঘরগুলো মেরামত করে তাঁদের একটু থাকার উপযোগী করে দেওয়া হোক।
আবাসন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জামাল হোসেন জানান, বর্তমানে অর্ধেক ঘর খালি আছে। আর সবগুলো মেরামত করা দরকার। এসব ঘরে এখন আর থাকা যায় না। তাদের প্রত্যেককে চালের টিন দেওয়া হলে অন্তত বৃষ্টিথেকে রক্ষা পেতে পারতেন। জানালেন, গামুরিবুনিয়া মৌজায় মনোরম পরিবেশে ছয় একর খাস জমিতে এই আবাসনটি করা হয়। যেখানে ১০টি ব্যারাক করা হয়। প্রত্যেকটি ব্যারাকে দশটি করে কক্ষ রয়েছে। প্রত্যেককে তিন শতক জমিসহ ঘরের মালিকানার দলিল দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকের দলিল এখন পর্যন্ত হাতে পৌছেনি। তিনদিকে ব্যারাক করা এই আবাসনের মাঝখানে একটি বিরাট দিঘির সাইজের পুকুর রয়েছে। এখন সেখানে মাছের চাষও করতে পারেন না। ঘাটলা দুটি ধসে গেছে। ব্যবহার করতে পারেন না। ঘরের সামনে পুকুর পাড়ের রাস্তাটি কাদামাটির। টিউবওয়েল পাঁচটির সব কয়টি নষ্ট।
পানি ওঠে না। টয়লেটগুলো সব অকেজো। কম্যুনিটি সেন্টারটি বিধ্বস্ত দশায় রয়েছে। সামনে অব্যবহৃত জমিতে সবজির আবাদও করতে পারেন না। কবরস্থানের চারদিকে বেড়া দেওয়ার সংগতি নেই। পারেনি মসজিদটি পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তুলতে। সামনের যোগাযোগের সড়কের কালভার্টটি করা হলেও রাস্তাটি পাকা না করায় বর্ষায় ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। নিজেদের চলাচলেও ভোগান্তির শেষ নেই। এসব মানুষগুলো এখন জীবন-জীবিকার চাকা সচল করবেন, না ঘর মেরামত করবেন। কোনোটাই পারছেন না। নেই কোন তাদের আর্থিক সংগতি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, যদি বরাদ্দ পাওয়া যায় কিংবা সুযোগ থাকে তবে আবাসনের জীর্নদশার স্থাপনাগুলো মেরামত করা হবে।
সাব্বির