ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ জুন ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১

বহু গুণে গুণান্বিত তালের শাঁস

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে

শেখ আব্দুল আওয়াল ও হোসাইন আলী কাজী

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২২ মে ২০২৪

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে

গফরগাঁওয়ে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে তালের শাঁস খেয়ে তৃপ্তি মেটাচ্ছে এক শিশু ও শ্রমিক

ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ, ঐ খানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’... কানা বগীর ছা এখন তাল গাছে থাকুক আর না থাকুক গ্রাম এখন আর আগের মতো তাল গাছ দেখা যায় না। জ্যৈষ্ঠ মাসে দেখা মেলে তালের শাঁসের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। প্রচণ্ড গরমে হঠাৎ করেই কদর বেড়ে যায় তালের শাঁসের। একটি ভিন্নধর্মী রসালো ফল তালের শাঁস।

অনেক মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী তাল গাছ থেকে পাইকারি কিনে অপরিপক্ব তাল (ছোট) অধিক লাভের আশায় বাজারে এনে বিক্রি করেন বিভিন্ন দামে। তবে নরম অবস্থায় তালের শাঁসের দাম অনেক বেশি। দিন যত যেতে থাকে তালের শাঁস শক্ত হতে থাকে। 
তাল গাছের বাবরি ডালে লুকিয়ে থাকে রসে ভরা তালের শাঁস। শৈশবে দলছুট বন্ধুদের দুরন্তপনা অথবা কখনো বাজি ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে তালের শাঁস খাওয়ার দৃশ্য অনেকের মনে নাড়া দেয়। 
অঞ্চলভেদে এক কেউ বলে তালের শাঁস, কেউ বা বলে তাল কুর, আবার কেউ বলে তালের আঁটি।
গ্রীষ্মের দাবদাহে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি খাবার কচি তালের শাঁস। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার লংগাইর ইউনিয়নের বাসিন্দা শহিদুল্লাহ রতন বলেন, তালগাছ চুক্তিতে কিনে নেন তারা। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসে তালের শাঁস পূর্ণতা পায়। গাছভেদে আগে-পরে শাঁস পরিপক্ব হয়। তবে শাঁস একটু নরম অবস্থায় খেলেই বেশি স্বাদ পাওয়া যায়। গাছ থেকে কচি তাল নামানো হয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।

একজন লোক বাঁশ দিয়ে তাল গাছে উঠে তালের কাঁদিগুলো দড়ি বেঁধে নিচে নামিয়ে দেন। নিচে থাকা আরেকজন লোক দড়ি খুলে দেন। এভাবে গাছ থেকে কচি তাল নামানো হয়। তালের শাঁস পিস হিসেবে বিক্রি হয়। বিক্রেতা কচি তালের পাশে দা নিয়ে বসে থাকেন। বিক্রি করা তাল মুহূর্তে কেটে শাঁস বের করে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

তিনি আরও একটি তালের মধ্যকার শাঁস প্রকার ভেদে ২৫-৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এতে তার প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ৩৫শ’ টাকা বেচা কেনা হয়। তিনি জানান, একটি তাল গাছ মৌসুম শুরুর আগেই ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকায় ক্রয় করা হয়। প্রায় তিন মাসের এই ব্যবসায় গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা লাভ হয়। মাসে লাভ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা।
তালের শাঁসকে নারকেলের মতোই পুষ্টিকর বলে বিবেচনা করা হয়। খেতে সুস্বাদু। এতে প্রচুর পরিমাণ পানি থাকে, যা অনেকটা ডাবের পানির মতো। তালের শাঁসে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ফাইবার এবং খনিজ উপাদান থাকে। পুষ্টিবিদদের মতে, ডাবের পানি ও তালের শাঁসের গুণাগুণ একই রকমের। 
গরমে শরীর ঠা-া রাখতে সাহায্য করে তালের শাঁস। প্রচণ্ড গরমে তালের কচি শাঁস এবং এর ভেতরের মিষ্টি পানি তৃষ্ণা মিটিয়ে শরীরে এনে দেয় আরামদায়ক অনুভূতি। এ ছাড়া এই সময় তাপমাত্রার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চুল পড়া ইত্যাদি রোধ করতে সাহায্য করে এটি। অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীর থেকে যে পানি বেরিয়ে যায়, তা পূরণ করতে সাহায্য করে তালের শাঁস।

পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যা এবং হজমের সহায়ক হিসেবে প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে তালের শাঁস। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আলসার ও এসিডিটি দূর করতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. খোরশেদ আলম বলেন, প্রসূতি নারীদের হজমের জন্য তালের শাঁস বেশ উপকারী। ক্যালরির পরিমাণ কম থাকায় তালের শাঁস ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করে থাকে।

বমি ভাব আর মুখের অরুচিও দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে থাকা ভিটামিন ‘সি’ ও ‘বি’ কমপ্লেক্স খাবারে রুচি বাড়াতে সাহায্য করে।
তালের শাঁসে ক্যালসিয়াম থাকায় এটি দাঁতের জন্য অনেক ভালো। দাঁতের অ্যানামেল ভালো রাখে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। তালের শাঁস হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে। কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূরীকরণে দারুণ ভূমিকা রাখে। তালের শাঁসে আছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, সালফার, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো বেশকিছু উপকারী উপাদান, যা আমাদের চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

এ ছাড়া অ্যালার্জিসহ চোখের অন্যান্য রোগের প্রকোপ কমাতে তাল অনেক কার্যকর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বিএমএ সাবেক সভাপতি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. হোসাইন আহম্মেদ গোলন্দাজ জনকণ্ঠকে বলেন, তালের শাঁস খেলে লিভারের সমস্যা দূর হয়। তালের শাঁস রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গরমের কারণে ত্বকে কোনো ধরনের র‌্যাশ বা ব্রণ দেখা দিলে তালের শাঁস মুখে লাগানো যায়। এতে ত্বকের সমস্যা দূর হয়। 
আমতলী, বরগুনা ॥ প্রচ- দাবদাহে দক্ষিণাঞ্চলে তালের শাঁসের কদর বেড়েছে। মানুষ শরীরে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে তালের শাঁস কিনে খাচ্ছেন। দাম কিছুটা বেশি হলেও সেদিকে তাকাচ্ছেন না ক্লান্ত ও পরিশ্রমী মানুষগুলো। শহরের বেশির ভাগ মানুষের কাছে তালের শাঁসের কদর বেশি। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় সড়ক পথে অনায়াসে দক্ষিণাঞ্চলে তালের শাঁস ঢাকায় যাচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা বেশ লাভবান হচ্ছে। 
তাল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বোরাসাস ফ্লাবেলিারও। এটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন ফল গাছ। গ্রামাঞ্চলে পানি তাল হিসেবে পরিচিত। তালের ফল এবং বীজ বাঙালির খাদ্য। তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরি হয়। তালের বীজও খাওয়া হয় লেপা বা তালশাঁস নামে।

তালে রয়েছে প্রচণ্ড ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক পটাশিয়াল, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ অনেক খনিজ উপাদান। তালে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান রয়েছে বলে জানান পুষ্টিবিদ ডা. মাসুম বিল্লাহ। প্রচ- দাবদাহে ক্লান্ত মানুষ তালের শাঁসের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। শরীরের ক্লান্তি দূর করতে মানুষ তালের শাঁস খান। তবে এ বছর প্রচ- দাবদাহে তালের শাঁসের কদর গত কয়েক বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

তালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ব্যবসায়ীরা গ্রামগঞ্জ থেকে তাল সংগ্রহ করে সড়কের পাশে ও অলিগলিতে বিক্রি করছেন। মানুষ অহরহ ফরমালিন মুক্ত এ ফল খেয়ে খাকে। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ ফলে ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ জলীয় অংশ, ক্যালরি ২৯, শর্করা ৬ দশমিক ৫ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ৪৩ মিলিগ্রাম, খনিজ শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ও ৪ মিলিগ্রাম রয়েছে তালের চাহিদা থাকায় বিচি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।

বড় তাল প্রতি বিচি শাঁস ৫ টাকা করে তিন বিচি তালের শাঁস বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা।  আবার ছোট তালের বিচির শাঁস ৩ টাকা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা মূল্যের দিকে না তাকিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কিনে নিচ্ছেন।  অপরদিকে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর অনায়াসে তালের শাঁস রাজধানী শহর ঢাকায় যাচ্ছে। এতে বেশ টাকা আয় করছেন ব্যবসায়ীরা।
দক্ষিণ আমতলী গ্রামের ব্যবসায়ী বাহাদুর আকন বলেন, গ্রামাঞ্চল থেকে তালের শাঁস ক্রয় করে বাস গাড়িতে ঢাকায় পাঠাচ্ছি। এতে বেশ লাভবান হচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় তালের শাঁসের বেশ চাহিদা রয়েছে।  
বুধবার আমতলী পৌর শহরের একে স্কুল বাঁধ, চৌরাস্তা, হাসপাতাল প্রাঙ্গণ, লঞ্চঘাট ও আমতলী-পটুয়াখালী মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান ঘুরে তালের শাঁস বিক্রি করতে দেখা গেছে। প্রতি বিচি শাঁস ৫ টাকা দরে মানুষ কিনে নিচ্ছে। 
হলদিয়া ইউনিয়নের তুজির বাজার এলাকার তাল ব্যবসায়ী মন্টু মোল্লা বলেন, গ্রাম থেকে গাছ মূলে তাল ক্রয় করে ভ্যানে গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করি। প্রতি পিস তাল কিনতে হয় প্রকারভেদে ৩-৭ টাকা। বিক্রি করি ৫-১২ টাকা। তিনি আরও বলেন, গত ২৫ দিন ধরে বিক্রি করছি। এতে দৈনিক ৯শ’ থেকে এক হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আয় যেমন কষ্টও তেমন। 
আমতলী পৌর শহরের একে স্কুল লেক পাড়ের নারী তালের শাঁস ব্যবসায়ী মোসা. মঞ্জু বেগম বলেন, ছোট তাল ৩ টাকায় ক্রয় করে বিচি হিসেবে ৫-৬ টাকা  এবং বড় তাল ৭ টাকায় ক্রয় করে বিচি হিসেবে ১২-১৫ টাকায় বিক্রি করছি। এতে দৈনিক গড়ে এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ’ টাকা বিক্রি হয়। তিনি আরও বলেন, রোধ বৃদ্ধি পেয়ে তাদের চাহিদা বাড়ে। রোদ কমলে চাহিদা কমে যায়। 
ক্রেতা সবুজ মিয়া বলেন, পরিবার পরিজনের জন্য ১০ টাকা পিস হিসেবে এক ডজন তাল কিনেছি। তিনি আরও বলেন, বাজারে পানি তালের চাহিদা বেশি।

×