ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সৈয়দপুরে একাত্তরের উত্তাল মার্চ

মাহাতাব বেগের মাথা কেটে শহরে উল্লাস করেছিল অবাঙালিরা

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:০০, ৪ মার্চ ২০২৪

মাহাতাব বেগের মাথা কেটে শহরে উল্লাস করেছিল অবাঙালিরা

উত্তাল মার্চে নীলফামারীর সৈয়দপুরে প্রথম শহীদ হন মীর্জা মাহাতাব বেগ

১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে নীলফামারীর সৈয়দপুরে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল পাকি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার ও  বিহারিরা। বাঙালি যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন তা দমনে নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। শহরজুড়ে শুরু করে ব্যাপক লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘিরে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর সৈয়দপুর ছিল ভিন্নধারার শহর।

সেখানে উত্তাল মার্চে বাঙালিদের ধরতে পারলে পাকি বাহিনীর দোসররা খতম করে দিত। এরজন্য তারা বানিয়েছিল  খরচা খাতা।  দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছরে সেই উত্তাল মার্চের দিকে তাকালে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা কথাও। 
ব্রিটিশ আমলে নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা স্থাপিত হওয়ার পর চাকরির আশায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল উপমহাদেশের উর্দুভাষীরা। তারা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নানা সময়ে বাঙালিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিরোধ লেগেই থাকত। একাত্তরে তাদের দখলদারিত্ব আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অনেক নির্যাতন-অত্যাচারের শিকার হন বাঙালিরা।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় সৈয়দপুরের অবাঙালিরা। দিনে দিনে সৈয়দপুরের বাঙালিরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সৈয়দপুরের বাঙালিরা মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। এ নিয়ে বাঙালিদের অবরুদ্ধ করে অবাঙালিরা।

পাকিস্তানি সেনা- অবাঙালিদের নির্যাতন ও হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শহীদ ডা. জিকরুল হকসহ অনেকে। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের আটকে রেখে বিমানবন্দরে মাটি কাটার কাজে লাগিয়ে দেয় ও বাঙালিদের ওপর জুলুম, নির্যাতন চালায়। এতে শহরে বাঙালিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। 
২৪ মার্চ সকাল থেকে চারদিক থেকে সৈয়দপুর ঘেরাও শুরু করেন বাঙালিরা। বেলা ১১টায় সৈয়দপুরের পূর্বদিকে গোলাগুলি শুরু হয়। দুপুর ১২টায় রানীরবন্দরের সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মীজ্র্া মাহাতাব বেগ সৈয়দপুর শহরের পশ্চিম দিক থেকে সৈয়দপুরের দিকে এগোতে থাকেন। 
তার সঙ্গে কয়েক হাজার জনতা যোগ দেন। মাহাতাব বেগ একটি পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে সৈয়দপুর ঘেরাও করতে যান। সাধারণ জনতার হাতে ছিল তীর-ধনুক, লাঠিসোঁটা আর বল্লম। মাহাতাব বেগের সঙ্গে হাজার হাজার জনতা সৈয়দপুরের দিকে এলে খড়খড়িয়া নদীর সামনে পাকিস্তানি সেনাসহ অবাঙালিরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন মাহাতাব বেগ।

তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। গুলিবিদ্ধ মাহাতাব বেগকে বাঁচাতে এসে নিহত হন মোহাম্মদ আলী নামের একজন বাঙালি রেলওয়ে শ্রমিক।
পাশাপাশি মাহাতাব বেগের ভাই ও ছেলেদের সঙ্গে পাকসেনা এবং অবাঙালিদের গোলাগুলি চলতে থাকে। তখন গুলিবিদ্ধ হন মাহাতাব বেগের ছেলে মির্জা সালাউদ্দিন বেগ। পাকসেনা ও অবাঙালিদের গুলি ও হাতবোমার তা-বে মাহাতাব বেগকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেখে খড়খড়িয়া নদীর ওপারে পালিয়ে  যেতে বাধ্য হন সাধারণ জনতা। সেদিন পাকসেনার গুলিতে নিহত রেলওয়ে শ্রমিক মোহাম্মদ আলীর মরদেহ তার পরিবার পেলেও মাহাতাব বেগের মরদেহ সৈয়দপুর শহরে নিয়ে যায় পাকসেনারা।

শহরে আনার পর কসাই ডেকে মাহাতাব বেগের মাথা কেটে আলাদা করে বল্লমের মাথায় ছিন্ন মস্তক নিয়ে গোটা শহরে উল্লাস করেছিল অবাঙালিরা। সেদিন তারা হুমকি দিয়েছিল পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেই সবার অবস্থা মাহাতাব বেগের মতো হবে। মূলত এটিই ছিল পাকবাহিনী ও সৈয়দপুরের অবাঙালিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ যুদ্ধ।
মাহাতাব বেগের দ্বিতীয় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা মো. সালাউদ্দিন বেগ বলেন, বাবা  সৈয়দপুর শহরে এসেছিলেন অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধার করতে। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধযুদ্ধ। এ সময় একটি তপ্ত বুলেট বিদ্ধ হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা মাহাতাব বেগের তলপেটে। 
মাহাতাব বেগ ছিলেন লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জন্ম দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাতনালা ইউনিয়নের জমিদার পরিবারে। বাবা আবদুল হামিদ বেগ ছিলেন জমিদার। মা মতিফুল বিবি। দিনাজপুরের দৈনিক উত্তরাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতেন। ভালো অভিনয়ও করতেন। দিনাজপুরকেন্দ্রিক অনেক নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রানীর বন্দর বাজারে গড়ে তুলেছিলেন নজরুল পাঠাগার। এখানে নিয়মিত বসত সাহিত্যের আসর।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছয় ছেলে, সাত মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ও দুই মেয়ে মারা গেছেন। স্ত্রী সালেহা বেগম।
শহীদ মাহাতাব বেগের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। দেশ বিভাগের আগে ব্রিটিশ হোমগার্ডের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া আনসার বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এসব তথ্য পাওয়া গেছে গবেষক অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমানের লেখা মুক্তিযুদ্ধে রঙ্গপুর গ্রন্থ থেকে।

সালাহউদ্দিন বেগ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর বাবা মাহাতাব বেগ নিজ গ্রাম সাতনালার শত শত মানুষকে প্রশিক্ষণ দেন। এক সময় খবর পান, সৈয়দপুরের বাঙালিদের অবরুদ্ধ করে অবাঙালি আর পাকিস্তানি সেনারা চরম নির্যাতন, লুণ্ঠন চালাচ্ছে। এই অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
মাহাতাব বেগ কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে নিয়ে ২৪ মার্চ সকাল আটটায় পায়ে হেঁটে সৈয়দপুর শহরের দিকে রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ছেলে এম এ রশিদ বেগ (২৮), সালাউদ্দিন বেগ (১৮) ও আবদুর রউফ (১৭)। খড়খড়িয়া সেতু পার হয়ে সৈয়দপুর শহরে ঢোকার মুখে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ বাধে। একপর্যায়ে একটি বুলেট মাহাতাব বেগের তলপেটে বিঁধে। এরপর অবাঙালিরা তলোয়ার দিয়ে ছিন্ন করে মাহাতাব বেগের মাথা।

ছিন্ন মস্তক হাতে নিয়ে তারা খোলা জিপে চেপে শহরে আনন্দ মিছিল করে। স্বাধীনতার পর সৈয়দপুর শহরের জিআরপি চত্বরে শহীদ স্মরণে নির্মিত স্মৃতি অম্লান সৌধের নামফলকে শহীদ মাহাতাব বেগের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। চিরিরবন্দর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত উপজেলার শহীদ স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম রয়েছে। মাহাতাব বেগের স্মরণে সৈয়দপুরে গঠন করা হয়েছে মাহাতাব বেগ স্মৃতি সংসদ। 
৪ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. জিকরুল হক, তুলসীরাম আগরওয়ালা, ডা. সামছুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ডা. ইয়াকুব আলী, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা, নারায়ণ প্রসাদ, কমলা প্রসাদ প্রমুখকে সৈয়দপুর সেনানিবাসে হাত-পা বেঁধে রাখা হয় এবং ১২ এপ্রিল তাদের চোখমুখ বেঁধে রংপুর সেনানিবাসের উত্তরপার্শ্বে উপশহরে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার পদস্থ কর্মচারীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকসেনা ও তাদের অবাঙালি দোসরদের হাতে নিহত হয়েছে অসংখ্য রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, চাকুরে ও সাধারণ মানুষ।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন উপজেলা শহরটিতে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা বড় ধরনের গণহত্যা চালায়। এদিন শহরের ৪৩৮ জন মাড়োয়ারি পরিবারের সদস্যকে ভারতের হলদিবাড়ি সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার নামে ট্রেনে তুলে রেলওয়ে কারখানার উত্তরপ্রান্তে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে লুটে নেওয়া হয় তাদের সর্বস্ব। শুধু তাই নয়, সেদিন রক্ষা পায়নি বাঙালি শিশুরাও। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নি®পাপ শিশুদের হত্যা করা হয়।
অনেকে দুঃখ করে বলেন, সৈয়দপুরে বাঙালিরা বাংলাভাষায় কথা বলার চেয়ে উর্দুভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন! মনে হবে এখনো অবাঙালিদের রাজত্ব চলছে এখানে। সৈয়দপুরের অবাঙালিরা এখনো উদুর্তেই কথা বলছে, মাইকিং করছে। দেশ স্বাধীন হলেও সৈয়দপুরে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। দেখে মনে হয় সৈয়দপুর এখনো স্বাধীন হয়নি।
শহীদ মাহাতাব বেগ স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. সুজাউদ্দৌলা সুজা বলেন, সৈয়দপুর উপজেলায় প্রথম শহীদ হন মাহাতাব বেগ। নতুন প্রজন্মের কাছে তার স্মৃতিকে ধরে রয়েছি আমরা। সৈয়দপুর ঘেরাও আন্দোলন হয়েছিল; এটি সৈয়দপুরে পাকসেনা ও তার দোসরের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। মাহাতাব বেগ মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুরে প্রথম শহীদ হন।

×