অমর একুশে বইমেলায় বৃষ্টির বাগড়া। ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় স্টলের সামনের অংশ
অমর একুশের দিনটি গত হলো। প্রতিবারের মতো এবারও শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে জনস্রোত নেমেছিল ঢাকার রাস্তায়। একুশের প্রথম প্রহরেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এখন সেই অর্থে প্রভাতফেরি হয় না। তবে রাতে শহীদ বেদিতে যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শুরু হয়েছিল তা দুপুরের আগ পর্যন্ত চলেছে। এর বাইরে রাজধানীজুড়েই নানা আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অধিকাংশ মানুষকে কালো রঙের পোশাক পরে ঘর থেকে বের হতে দেখায় যায়। কিন্তু এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, আরও হোক। হবেও। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যের জায়গাটা আসলে কী? ২১ ফেব্রুয়ারি যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সে ইতিহাস থেকে কি শিক্ষা আজকের প্রজন্ম নিতে পারে? কেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরাও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে দিব্যি সম্পূর্ণ মনে করছে নিজেদের? চারপাশে এত যে আপস, এত যে মাথা নুইয়ে বাঁচা- কী তাহলে শিখলাম আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে? আরও অনেক প্রশ্ন।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাও কি আজ জরুরি হয়ে পড়েনি? একটার পর একটা প্রজন্ম ইতিহাস থেকে, শেকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। স্থূল যত চর্চা, চর্চা তো নয় অপচর্চা বলি, তারা তা-ই নিয়ে বেশ আছে। হেয়ালি ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ উগ্রতা অসহিষ্ণুতা তাদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারও ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই। এ কেমন কথা? এইসব চলতে থাকলে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো আমরা কি ধরে রাখতে পারব? প্রশ্নগুলো না তুললেই আর নয় আসলে। সব দেখে মনে হয়েছে, এবারের অমর একুশে প্রশ্নগুলো তোলার, উত্তর খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়ে গেছে।
অভিন্ন চিত্র বইমেলায় ॥ অমর একুশে পালনের অংশ হিসেবে এখন রাজধানীতে চলছে অমর একুশে বইমেলা। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ জমজমাট। প্রতিদিনই মানুষের ভিড়। জটলা। কোনো কোনো দিন তো ঢুকতে বের হতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু বই সংগ্রহের খবর কী? ক’জন বই কিনছেন? না, এ জন্য জরিপ করতে হবে না। দিব্য দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষ মেলায় আসছে বেড়াতে। ঘুরতে। আর ছবি তুলতে।
স্টল প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বই হাতে নিয়ে তারা ছবি তুলছে। ফেসবুকে পোস্ট করে বাহবা নিতেও ভুল করছে না। অথচ হাতে নিয়ে ছবি তোলা বইটির নাম কী, কার লেখা, গদ্য না পদ্যÑ এটুকু তথ্যও তারা জানার চেষ্টা করছে না। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা বা বাড়ানোর বিষয়টি তো আরও অনেক দূরের কথা।
সে যাই হোক, মেলা এভাবেই চলছে। বৃহস্পতিবার ছিল ২২তম দিন। আগের দিনের পায়চারিতে চিরে চ্যাপ্টা মেলা এদিন কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। তবে এদিনই প্রথম বাগড়া বাঁধিয়েছিল বৃষ্টি। বিকেলে মেলা শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে হালকা বৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়। হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য হলেও আকাশ যেন ভেঙে পড়ে। ওমনি দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। বই সামলাতে ব্যস্ত হন স্টল কর্মীরা। দিগি¦দিক ছুটতে থাকে সাধারণ মানুষ। কেউ স্টলে ঢোকার চেষ্টা করেন। কেউ ভিজতে বাধ্য হন।
কারণ এবারের মেলায় আয়োজকরা বৃষ্টি বা অন্য কোনো দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা রাখেনি। এর আগে স্বনামধন্য স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর মেলার পরিকল্পনায় বড় ছাউনি রেখেছিলেন। এবার বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষই সব করেছে। ফলে একটা লেজে গুবড়ে অবস্থা মেলায় লেগেই আছে। ভাগ্যিস অল্পতে থেমে গিয়েছিল বৃষ্টি। তাতেই রক্ষা। আগে প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি বৃষ্টি বিঘিœত দিনে একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে ৭৮টি নতুন বই।
বই নিয়ে আলোচনা ॥ বই-সংলাপ ও রিক্সাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজনে বৃহস্পতিবার বইমেলায় ‘বাংলার চিত্রকলা : ইতিহাসের বিভ্রান্তি এবং মনন-মনীষায় ইউরোপমুখিনতার মর্মভেদ’ ও ‘ফ্রয়েডিয় লিবিডো-তত্ত্ব এবং তান্ত্রিক দেহাত্মবাদ : সমীক্ষণ ও তুলনামূলক বিচার’ শীর্ষক দুটো বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় মেলার মূল মঞ্চে যথারীতি ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।