ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে যাত্রাপালা

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০১:১৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে যাত্রাপালা

বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার একটি দৃশ্য (ছবি: সংগৃহীত)

যাত্রা! যাত্রা!! যাত্রা!!! এক ঝাঁক উড়ন্ত পরীর ঝুমুর ঝুমুর নৃত্যের তালে বাসন্তী অপেরার আজকের যাত্রাপালা ‘ফকির মজনু শাহ।’ মঞ্চস্থ হবে সিরাজগঞ্জের নিউ মার্কেট প্রদর্শনী মাঠে। যাত্রা সম্রাট স্বপন দত্ত ও মিরা দত্ত অভিনীত এই যাত্রা পালায় আরও থাকছে টালিউডের নৃত্য শিল্পীর মনমাতানো নাচ ও গান। আবার ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’ যাত্রাপালা কিংবা সবুজ অপেরা পার্র্টির ‘রক্ত দিয়ে কিনলাম’ যাত্রানুষ্ঠানের হাই ভোল্টেজে মাইকের এমন আওয়াজ এখন আর শোনা যায় না।

২০০১ সালের আগ পর্যন্তও সিরাজগঞ্জ শহরের নিউ মার্কেট প্রদর্শনী মাঠ, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ, স্টেডিয়াম মাঠে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে এবং উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন ক্লাবের উন্নয়নকল্পে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত দুই দশকে যাত্রাপালা সিরাজগঞ্জের মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। যাত্রাপালা দলের মালিক এবং শিল্পীরা এ পেশা থেকে দূরে চলে গেছে। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে স্বপন দত্ত ও নারী শিল্পী মিরা দত্তের নাম উল্লেখযোগ্য।
যাত্রাপালা গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে আনন্দের একটি অনুষঙ্গ। গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের প্রতি আলাদা একটি আকর্ষণও রয়েছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। যাত্রাঙ্গন এখন মৃতপ্রায়। কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জঙ্গী তৎপরতা, বাংলা নববর্ষে রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বিভিন্ন স্থানে মেলায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তাজনিত কারণে সমগ্র উত্তরবাঞ্চল এবং আরও কয়েকটি জেলায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যাত্রা অনুষ্ঠানের অনুমতি বন্ধ করে দেয়।

যাত্রাঙ্গনেও সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। বোমা হামলার বিপাকে পড়েন পেশাদার যাত্রাদল মালিক ও শিল্পীরা। একেকটি যাত্রাদল গঠন করতে প্রায় ২০ লাখ টাকা পুজি বিনিয়োগ করতে হয়। অনেক শিল্পীর জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমই হচ্ছে যাত্রা। এ পরিস্থিতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে মালিকদের পুঁজি যেমন উঠে আসবে না, তেমনি চুক্তিভুক্ত শিল্পীদেরও বেতন ও সম্মানী পরিশোধ করা সম্ভবপর হবে না। এছাড়াও যাত্রাশিল্পের প্রযোজনার মান ক্রমশই তলানীতে পৌঁছায়।

বাস্তবিক অভিনয়ের পরিবর্তে অধিকাংশ যাত্রা প্যান্ডেলে দেখা গেছে অশালীন-অশ্লীল নৃত্যগীতের রমরমা আয়োজন। অর্ধনগ্ন শরীর দোলানোয় যাত্রা পালা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার আরও একটি কারণ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসব অসামাজিক কর্মকা-ের জন্যে মূলত দায়ী বিকৃত রুচির প্রদর্শক এবং উঠতি বয়সের দর্শকরা। এদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। 
এক সময় যুদ্ধ ক্ষেত্রের অভিনয়ে মেকি তলোয়ারের ঝলঝনানি আর বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে যাত্রা মঞ্চ কেঁঁপে উঠেছে। বিবেকের গান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রোতাকে টেনেছ্ েনর্তকীর নাচে দর্শকেরা আনন্দ উপভোগ করেছে। এখানে শিক্ষনীয়ও ছিল অনেক। বিবেকের গানে পরিবার ও সমাজের চিত্রও ফুটে উঠেছে। সেই যাত্রাপালা এখন মানুষের স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। 
১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’ বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য দল হিসেবে পরিগণিত হয়। সিরাজগঞ্জের নারায়ণচন্দ্র দত্ত ছিলেন এই দলের অধিকারী। ১৯৬০ সাল থেকে এই দলে নারী শিল্পীরা অভিনয় করতে শুরু করে। বাবুল অপেরার পরে নারীশিল্পী সংযোজনের দিক থেকে দ্বিতীয় দল হল ‘বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’। এই দলে এসময়ে পরিচালক ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস।

নারী শিল্পী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ও জয়শ্রী প্রামাণিক ছাড়া এই দলে পুরুষ শিল্পী ছিলেন তুষার দাশগুপ্ত, ঠাকুরদাস ঘোষ, কালী দত্ত, ফণীভূষণ, অমিয় সরকার প্রমুখ। পরে স্বপন দত্ত এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে ওঠেন।
সিরাজগঞ্জে যাত্রাপালার দল তেমন একটা ছিল না। তবে অভিনয় শিল্পী নারী ও পুরুষ অনেকেই ছিলেন। জেলার শাহজাদপুরে বাসন্তী অপেরা পার্টি নামের একটি যাত্রাপালার দল ছিল। মালিক ছিলেন স্বপন দত্ত। তিনি প্রয়াত। তার মৃত্যুর পর বাসন্তী অপেরার কর্তৃত্ব নিয়ে সংকটের সৃষ্টি হয়। অভিনয় শিল্পীরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাসন্তী অপেরার অস্তিত্ব এখন আর নেই। নায়িকা থেকে মা মাসি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিরা দত্ত। তিনিও প্রয়াত। সিরাজগঞ্জ শহরের নারী অভিনয় শিল্পী জরিনাও মারা গেছেন।

নবাব সিরাজ উদ্দৌালার সিপাহ সালারের অভিনয় করতেন মিন্ট্-ু তিনি বেঁচে আছেন, তবে যাত্রা শিল্পের সঙ্গে আর নেই। তিনি পেশা বদল করেছেন। শহরতলীর জানপুর গ্রামের এই অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে কথা কলে জানা যায়- ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি যাত্রাপালার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন পেশা বদল করেছেন। কারণ জঙ্গী স্থানে, রমনার বটমুলে, যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন স্থানে মেলায় বোমা হামলার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

এছাড়াও যাত্রার নামে নর্তকীদের অশালীন ভাবভঙ্গিমা এবং নগ্ন নৃত্য তাকে এ পেশা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তা ছাড়াও যাত্রাপালার অস্তিত্ব সংকট তাকে পেশা বদলে বাধ্য করেছে। তিনি এও বলেছেন, যাত্রাপালায় অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে বেশি সংখ্যক গুণী শিল্পীরা মারা যাবার পর যাত্রাপালা গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে আনন্দের যে অনুষঙ্গ ছিল তারও ঘাটতি পড়েছে। এসব কারণেই গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যাত্রাপালা মানুষের স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। 
বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

×