![টোপা বালুশাহী মনসুরী বরফি ও মণিঘোষের রসগোল্লা টোপা বালুশাহী মনসুরী বরফি ও মণিঘোষের রসগোল্লা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/b1-2311211812.jpg)
মণিঘোষের রসগোল্লা, রসালো টোপা, বেলাইচ-ির বালুশাহী, মনসুর ও ডোমারের বরফি (ক্লকওয়াইজ)
মিষ্টি তৈরি একটি বিশেষ কলা। যারা মিষ্টি তৈরি করেন তাদের বলা হয় ময়রা। কিন্তু ময়রা শব্দটির সঙ্গে অনেকে পরিচিত নয়। সকলে তাদের মিষ্টির কারিগর বলেই চেনেন। আবার এলাকাভিত্তিক মিষ্টির প্রসিদ্ধি ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন অনেক মিষ্টিশিল্পী। তারা খ্যাতিমান হয়েছেন বিশেষ কোনো মিষ্টি তৈরির জন্যই।
উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুরকে ‘বাহের দেশ’ বলা হয়। এই ‘বাহের দেশে’ বিশেষ কিছু মিষ্টির ক্ষেত্রে সর্বশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন কোনো কোনো কারিগর বা ময়রা। তাদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে মিরগড়ের রসালো টোপা, বেলাইচ-ির বালুশাহী, সৈয়দপুরের মনসুরী, ডোমারের বরফি ও বীরগঞ্জের মণিঘোষের নামকরা রসগোল্লা।
মীরগড়ের টোপা ॥ হিমালয়ঘেঁষা উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছা করবে। মীরগড়ের টোপা এখন পঞ্চগড় জেলার অন্যতম ব্র্যান্ড। ধীরে ধীরে মুখরোচক এই মিষ্টির কথা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চ বা পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড়। তারই একটি মীরগড়। জেলার অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটি এটি। এই মীরগড়ে পাওয়া যায় রসালো টোপা। এখানে যারা বেড়াতে আসেন, তারা টোপার রসে মজে যান। স্থানীয় লোকজনের মতে, পুরনো খাবার হিসেবে টোপা মীরগড়ের ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
মীরগড় বাজারে গেলে দুই ধরনের টোপা পাওয়া যাবে। একটি চিনি দিয়ে বানানো, অন্যটি গুড়ের। একসময় টোপা বানানোর মূল উপকরণ ছিল চালের গুঁড়া আর ময়দা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে পরিবর্তন এসেছে। এখন টোপা বানানো হয় শুধু ময়দা দিয়ে। শুরুর দিকে টোপার আকৃতি ছিল লম্বাটে। এখন সেটি হয়েছে গোলাকার।
টোপার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার বহু আগে মীরগড়ে আন্ধারী রানী নামের এক প্রবীণ নারী বসবাস করতেন। তিনি মজাদার এই মিষ্টি নিজ হাতে বানাতেন। পরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করতেন। তিনিই রসাল এই মিষ্টির নাম দিয়েছিলেন টোপা। তখন প্রতিটি টোপা মাত্র দুই পয়সায় বিক্রি হতো।
আন্ধারী রানীর কাছ থেকে টোপা বানানোর কৌশল শিখে নেন মীরগড়ের মোমিনপাড়ার দুখু মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি। আন্ধারীর মৃত্যুর পর তিনি এই মিষ্টি বানানো শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দুখু মারা যান। এরপর থেকে টোপা বানাচ্ছেন দুখুর ছেলে আজিজুল ইসলাম। এখন টোপা বানানো ও বিক্রিতে আজিজুলকে সহায়তা করছেন তার ছেলে জাহের আলী। বংশপর¤পরায় তিনিই ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির হাল ধরবেন। এ ছাড়া মীরগড় বাজারে আরও কয়েকটি দোকানে এখন টোপা বিক্রি হয়। তবে আদি-অকৃত্রিম টোপা পেতে মানুষ এখনো ভরসা করেন আজিজুল-জাহেরের ওপর। টোপা কেজিতে বিক্রি হয়না। পিস হিসেবে একেকটি টোপার দাম এখন পাঁচ টাকা।
টোপা শুধু একটি মিষ্টি নয়, মীরগড় তথা পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যের অংশ, বলছিলেন মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান। তার ভাষ্য, মীরগড়ে বেড়াতে এসেছেন আর রসে টইটম্বুর টোপা খাননি, এমন ঘটনা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০২১ সালে পঞ্চগড় জেলা ব্যান্ড বুকে টোপার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
বেলাইচ-ীর বালুশাহী ॥ প্রত্যন্ত গ্রামের বাজার বেলাইচ-ী। এটি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। ওই গ্রামীণ বাজারে তৈরি হয় মজার মিষ্টি বালুশাহী, যা স্থানীয়ভাবে বালুশাই মিষ্টি নামে পরিচিত। এই মিষ্টি খাওয়ার জন্য ওই বাজারের ঈমান আলীর দোকানে প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত ভিড় থাকে। ক্রেতারা ১-২ কেজি করে বালুশাহী কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা।
বালুশাহী তৈরির কারিগর পরেশ চন্দ্র রায় (৪৫) বলেন, বাপ-দাদা সবাই মিষ্টির কারিগর ছিলেন। ঈমান আলীর হোটেলে আমি ১০ বছর ধরে বালুশাহী মিষ্টিসহ অন্যান্য মিষ্টি তৈরি করছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে যে বালুশাহী তৈরি হয়, এই দোকানের বালুশাহী তেমন নয়। অন্যান্য জায়গায় বালুশাহীর রং সাদা। মিষ্টির গায়ে চিনির শিরার আবরণ থাকে। এখানকার তৈরি মিষ্টির রং চকোলেট রঙের। স্বাদেও বৈচিত্র্যময়। ময়দা, গুঁড়া দুধ, সয়াবিন তেল, চিনি, জয়ফল, ছোট এলাচি, গ্লুøকোজ বিস্কুট, লবণ, ডিম দিয়ে এই মিষ্টি বানানো হয়। ক্রেতারা বলেন অনেক মজার মিষ্টি। এ বালুশাহীর সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক, সেই আশা করি।
ডোমারের বরফি ॥ দুধের ছানা, চিনি আর খেজুর গুড়ের মিশ্রণ এবং এক বিশেষ মসলায় বিশেষভাবে তৈরি হয় এ বরফি জাতীয় সন্দেশ। এই বরফির আদি কারিগর ছিলেন উপেন মোদি। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পৌরবাজারে রয়েছে উপেন মোদির আদি মিষ্টিঘর। এর খ্যাতি রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত থাকলেও এখন অনেকে আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরেও নিয়ে যাচ্ছে ডোমারের এই বরফি। ১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পর ডোমার উপজেলা বাজারে উপেন মোদি এই বরফি তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যার ঐতিহ্য এখন ধরে রেখেছেন উপেন মোদির বংশধর। কথা বলে জানা গেল ১৫ বছর আগে উপেন মোদি মারা যাওয়ার পর তার দুই ছেলে অমল রায়, সুভাষ রায় ও নাতি সুমন রায় তাদের বাপ-দাদার তৈরি এই বরফি ধরে রেখেছেন।
নাতি সুমন রায় জানালেন, শুনেছি দাদা উমেন মোদি যখন এই বরফি তৈরি করে বিক্রি করতেন তখন এর কেজি ছিল ১০ টাকা। তিনি জীবদ্দশায় বরফির কেজি সর্বশেষ ৩২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করে গেছেন। এখন প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেও লাভ টেকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে বলে জানালেন নাতি সুমন। এর পরেও দাদা উপেন মোদি তথা ডোমারের এই ঐতিহ্য বরফির কদর ধরে রাখতে প্রতিদিন ২০ কেজি বরফি বিক্রি করেন তারা। অপর দিকে এই বরফি ডোমারের আরও দুইটি মিষ্টির দোকান বিক্রি করে থাকে।
সৈয়দপুরের মনসুরী মিঠাই ॥ বিয়েবাড়ি কিংবা মিলাদ মাহফিলে মনসুরীর কদর থাকে সবচেয়ে বেশি। নীলফামারীর সৈয়দপুরের হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয় মনসুরী মিঠাই।
সৈয়দপুর শহরের গোলাহাট রেল কলোনির বাসিন্দা মো. ভোলার দাবি, বংশপর¤পরায় মনসুরী মিঠাইয়ের কারিগর। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বিহারি অধ্যুষিত জনপদ সৈয়দপুরে চলে আসেন। ভারতের বিহার রাজ্যের মুঙ্গের জেলার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সৈয়দপুরে তিনিই প্রথম মনসুরী মিঠাই বানিয়েছেন। পরে অন্যরা এই মিষ্টি বানাতে শুরু করেন। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এই মিষ্টি।
মনসুরী মিঠাই বানাতে প্রয়োজন হয় বেসন, ছোলার ডাল, চিনি ও সয়াবিন তেল। মো. ভোলা বলেন প্রথম যখন মনসুরী মিঠাই বানাতেন তখন ঘিয়ে ভাজতেন। বানানোর সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যেত। এখন ঘিয়ের বদলে সয়াবিন তেলে ভাজা হয় এই মিষ্টি। সৈয়দপুর শহরে আছে মিষ্টি ভা-ার। এর মালিক কামরুদ্দিন এসেছিলেন বিহার থেকে। মারা যান তিনি ২০০৪ সালে। এখন এই দোকান চালান তার একমাত্র ছেলে মো. কাওসার। তিনি বলেন, যত দূর জেনেছি, আফগানিস্তানের কাবুলের একজন ময়রার নাম ছিল মনসুর পাঠান। তার নামেই এই মিষ্টির নাম মনসুরী। তবে এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে। একটি মিষ্টির দোকানের স্বত্বাধিকারী সখেন ঘোষ বলেন, মনসুরী মিঠাই কম দামের মিষ্টি।
সবকিছুর দাম বাড়লেও এখনো এই মিষ্টি ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। সৈয়দপুরে শতাধিক রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ মণ মনসুরী মিঠাই তৈরি হয়। স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি আশপাশ থেকে আসা পাইকাররা মনসুরী মিঠাই কিনে নিয়ে যান। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলাতেও এটার ক্রেতা আছে। নতুন নতুন নানা পদের মিষ্টি আসছে। কিন্তু মনসুরী মিঠাইয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। মানুষ এখনো এই মিষ্টি আনন্দ নিয়ে খায়।
বীরগঞ্জের মণি ঘোষের রসগোল্লা ॥ ২০০২ সালে মণি ঘোষ মারা গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তার হাতে তৈরি সেই রসগোল্লা। যা ঐতিহ্য বহন করছে আজও। প্রয়াত মণি ঘোষ তরুণ বয়সে ১৯৫৪-৫৫ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে কাজের সন্ধানে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে এসেছিলেন। তারও আগে বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) মিষ্টির কারিগর হিসেবে কাজ করেছিলেন। মণি ঘোষের মামা বীরগঞ্জে হোটেল ব্যবসা করতেন। সেখানেই ছিল তার কর্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে বীরগঞ্জের ডাক্তারখানা মাঠসংলগ্ন একটি দোকানে নিজেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বীরগঞ্জে বিয়ে করেন মণি ঘোষ। তার শ্যালক মনোরঞ্জন ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে চলে মিষ্টির ব্যবসা।
পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের বীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুটি মিষ্টির দোকান। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ক্রেতারা মিষ্টির অর্ডার দিচ্ছেন এক কেজি থেকে শুরু করে পাঁচ কেজি, দশ কেজি পর্যন্ত। আবার আপনার সামনেই কেউ যদি এক বা আধা মণ মিষ্টির অর্ডার দেন, অবাক হবেন না। দোকান দুটিতে সারি সারি ট্রেতে সাজানো রয়েছে হরেক পদের মিষ্টি। সবচেয়ে বেশি চাহিদা রসগোল্লার, যা এখন ¯পঞ্জ মিষ্টি নামে পরিচিত। পাশাপাশি আছে মালাইকারি, ইন্দ্রাণী, তপসি, লেলচা ভোগ, রাজভোগ, কালোজাম, ছানার জিলাপি। বাহারি নামের পাশাপাশি স্বাদেও অপূর্ব এসব মিষ্টি। গরুর খাঁটি দুধের ছানা থেকে তৈরি এখানকার মিষ্টির খ্যাতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছে ইতোমধ্যে। দুটি দোকানেই আট-দশজন কর্মচারী কাজ করেন।
মিষ্টি ব্যবসায়ী মৃদুল কান্তি দেব জানান, মণি ঘোষই আমাদের মিষ্টির ঐতিহ্য দিয়ে গেছেন। সেই ঐতিহ্য দুটি দোকান করে ধরে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, বিভিন্ন গ্রাম থেকে খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে ছানা তৈরি করা হয়। রাত ৮টার পর শুরু হয় মিষ্টি বানানোর কাজ। চলে মধ্যরাত অবধি। প্রতিদিন তার দোকানে তিন-চার মণ মিষ্টি বিক্রি হয়। এগুলোর অর্ধেকের বেশি মণি ঘোষের সেই রসগোল্লা।
স্থানীয় একটি মিষ্টান্ন ভা-ারের বর্তমান স্বত্বাধিকারী মনোরঞ্জন ঘোষের ছেলে সুব্রত ঘোষ মাধব জানান, প্রতিদিন নিজ এলাকা ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে ক্রেতারা আসেন মিষ্টি কিনতে। মিষ্টি যায় ঢাকায়ও। প্রতি কেজি ¯পঞ্জ মিষ্টি ২২০, মালাইকারি ২৮০, ইন্দ্রাণী ৪০০, তপসি ২৫০, লেলচা ভোগ ২৫০, রাজভোগ ২০০, কালোজাম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হয়। ছানার জিলাপি প্রতি পিসের দাম ২০ টাকা।