ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঢাকা-১৩

আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী বিএনপি জাপায় একক

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৪ অক্টোবর ২০২৩

আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী বিএনপি জাপায় একক

জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুস সালাম, সাদেক খান, আজিজ আহমেদ ও শফিকুল ইসলাম

একদিকে রয়েছে বিশাল অট্টালিকা, ঝা চকচকে সড়ক, শপিংমল আর শত শত রেস্টুরেন্ট। অন্যদিকে বস্তি, ভাঙা রাস্তা, ধুলাবালি, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত আর মাদকের আখড়া। এখানে যেমন ধনী-উচ্চমধ্যবিত্ত একটি শ্রেণি রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। সব মিলিয়ে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতো একটি আসন ঢাকা-১৩। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরে বাংলা নগরের একাংশ নিয়ে জাতীয় সংসদের ১৮৬ নং আসন। বিশাল আয়তনের এই আসনে সিটি করপোরেশনের সাতটি ওয়ার্ড রয়েছে ।
গত পাঁচ বছরে সংসদীয় আসনের একাংশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। আরেক অংশে সড়ক দখল করে ফুটপাত বেড়েছে, বেহাল ভাঙা সড়ক আর ধুলাবালি নগরজীবনে স্বস্তি দেয়নি। এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত আর মাদকের স্পটে মারামারি নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ করেছে। সরেজমিন স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন তথ্যই জানা গেছে। যেকারণে সংসদীয় আসন থেকে মনোনয়ন দৌড় থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য সাদেক খান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমান নৌকা প্রতীকে মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এই আসন থেকে চমক দেখিয়ে নৌকার মাঝি হতে পারেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ।
বিএনপি প্রার্থী হিসেবে আব্দুস সালামের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আগামী নির্বাচনে আগেই জাতীয় পার্টি থেকে শফিকুল
ইসলাম সেন্টুকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। 
স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করলে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আসনটিতে। ভোটের যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের সমর্থক বেশি থাকায় কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকায় তারাও বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। তবে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকায় দল হিসেবে তারা কিছুটা স্বস্তিতে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীতার ওপর নির্ভর করবে তাদের অবস্থান।
সরেজমিন ঢাকা-১৩ আসন ঘুরে দেখা গেছে, এই আসটিতে কোনো দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৃশ্যমান জনসংযোগ নেই। ব্যানার-পোস্টারেও নেই তেমন প্রচার। তবে অনেকেই নিজস্ব কর্মীদের নিয়ে আসন গোছানোর কাজ করছেন।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল সড়কের চায়ের দোকানী ২৭ বছর এই এলাকায় বসবাস করছেন। গত ১৫ বছর ধরে এই এলাকার ভোটার তিনি। মোহাম্মদপুরে বিগত ১০ বছরে তাজমহল ও আশপাশের এলাকায় উন্নয়ন হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, যা উন্নয়ন হয়েছে তা নানক সাহেবের সময়। এই ৫ বছরে এই এলাকার উন্নয়নের আর কিছু নেই। সব সড়ক ভালো। তবে সাদেক খানের বাসা ( বেড়িবাঁধ) এলাকায় উন্নয়ন বেশি হয়েছে।
কৃষি মার্কেট এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আর পিছে তাকানোর সময় নেই। তবে মোহাম্মদপুর, আদাবরের মানুষ সচেতন। কেউ আর প্রতীক দেখে ভোট  দেবে  না। ভোট দেবে যোগ্য প্রার্থী দেখে। তিনি বলেন, এখন আর কেউ ভাত-কাপড় চায় না। এই এলাকায় যারা সচেতন ভোটার রয়েছেন তারা মুক্ত বাগস্বাধীনতা চায়।
স্থানীয়রা জানান, ১৩ নম্বর আসনটির আদাবর এলাকায় বহুতল ভবন। অন্যদিকে কাঁটাসুর, রায়েরবাজারের বস্তিতে রয়েছে মাদকের স্পট। ঢাকা উদ্যানে কিশোর গ্যাং। স্থানীয় ভোটারদের অভিযোগ মানুষ যতটা প্রত্যাশা করেছিল সেভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, আগামী নির্বাচনে এই বিষয়গুলো ভোটের যুদ্ধে প্রভাব ফেলবে। মোহাম্মদপুর, বসিলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খুবই বেহাল। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ছাড়াও এই সংসদীয় আসনের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মশা। 
এসব অভিযোগের বিষয়ে সাদেক খান জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তাঘাটের জন্য রোডস অ্যান্ড হাইওয়েকে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এখানে একটি বিপক্ষ দল আছে যারা এসব কথা বলে বেড়ান। তবে আমি এটুকু নিশ্চিত করছি, আমার আসনে কোনো দখলবাজদের জায়গা নেই। ৫ বছরে এটি হতেও দেইনি। যারা এগুলো করতে ব্যর্থ হচ্ছে তারাই এসব কথা বলছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৩০ হাজার ভোটার আমার গোষ্ঠীর। তারা আমাকেই সংসদ সদস্য হিসেবে চায়। তবে দলের সিদ্ধান্ত এক বাক্যেই মেনে নেবেন বলে জনকণ্ঠকে তিনি নিশ্চিত করেন।
ঢাকা ১৩ আসনে যেই সংসদ সদস্য হবেন তিনি যেন নেতা না হয়ে জননেতা হন সেই প্রত্যাশা জানিয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, দলীয় মনোনয়ন ২০০৮ সাল থেকেই কিনছি। এবারও  কেনব। নৌকার প্রার্থী হতে আমি বরাবরই মুখিয়ে ছিলাম। এবারও থাকব। তবে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেবেন বলে জনকণ্ঠকে তিনি জানান।
এর পরও কেন নির্বাচনী প্রচার নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন নির্বাচনী প্রচারের সময় নয়, এখন সুসংগঠিত হওয়ার সময়। রাজনীতি করে মানুষের পর্যাপ্ত সেবা করা যায় না। জনপ্রতিনিধি হলে সেবাটা করা যায়। আমি জানি না আগামী নির্বাচনে এ আসনে আমি চূড়ান্ত কি না। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা আছে। 
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের প্রভাব রয়েছে আসনটিতে। বিগত সময়ে দুই বার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীসভায় থাকায় তার অনুসারীও অনেক। নির্বাচন উপলক্ষে তিনিও প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। প্রতি জুমায় মুসল্লীদের সঙ্গে নামাজ পড়া, এলাকার অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি রয়েছে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। প্রতিটি নির্বাচনে আমাদের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা অংশ নেব। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন।
বিগত সময়ে আমি এমপি ও প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। আগামী নির্বাচনে আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি একমাত্র শেখ হাসিনা বলতে পারেন। নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রসঙ্গে সংবাদকর্মীরাও যেটা জানতে চেয়েছেন, আমার নেতাকর্মীরাও সেটা জানতে চায়। তবে তার উত্তর আমার কাছে নেই। ঢাকা-১৩ আসনের জনগণের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আত্মার সম্পর্ক। আমি এমপি নই, তবে এক মুহূর্তের জন্য তাদের কাছ থেকে দূরে ছিলাম না।  
২০০৮ সালের সীমানা পরিবর্তনের আগে এই আসনটি ছিল ঢাকা-৯। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি এই আসনের দখল নেয়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির হাতে ছিল আসনটি। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মকবুল হোসেন এ আসনের সংসদ সদস্য হন। ২০০১ সালে আবার আসনটি চলে যায় বিএনপির দখলে। সংসদ সদস্য হন খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে আসনটির সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হন আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংসদে আসনটির প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নং ওয়ার্ড এই সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত। সবশেষ তিন নির্বাচনে এ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

×