
দিনাজপুরে টেরাকোটায় সজ্জিত মন্দির
কান্তজীউ মন্দির দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যশিল্পের এক অপরূপ নিদর্শন ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। মন্দিরটি বিভিন্ন নামে পরিচিত- কেউ কান্তজীউ মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বলেন, অনেকের কাছে ‘নবরতœ’ মন্দির নামেও এটি পরিচিত। ১৮ শতকে নির্মিত মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে এক শান্তনিভৃত গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত। কালের সাক্ষী কান্তজীউ’র মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনী। অনেক মিথ-এর ভিড়ে কান্তজীউর মন্দির নিয়ে একটি অন্যতম মিথ হলো, ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ।
দিল্লির সিংহাসনে তখন মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসন চলছিল। এ সময় দিনাজপুরের জমিদারি বেশ খারাপ সময় পার করছিল। পর পর দুই বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে জমিদারির সিংহাসনে বসেন জমিদার প্রাণনাথ রায়। প্রাণনাথ রায় ছিলেন সব থেকে ছোট ভাই। জমিদার হিসেবে প্রাণনাথ রায় ছিলেন বেশ প্রজা দরদি। কথিত আছে, সে সময় প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করতে তিনি সে সময় খনন করেছিলেন ঐতিহাসিক রামসাগর দীঘি।
সিংহাসনে আরোহণের কয়েক বছর পর তাকে একটা বড় ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। সে সময় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট অঞ্চলের জমিদার ছিল রাজা রাঘবেন্দ্র রায়ের। পারিবারিকভাবেই দিনাজপুর ও ঘোড়াঘাটের জমিদারদের মধ্যে একটা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব ছিল। আর প্রাণনাথ সবে দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পালা বদলের পর জমিদারি হাতে নিয়েছেন। তাই রাঘবেন্দ্র রায়ের কাছে এটি বেশ ভালোই সুযোগ ছিল। তিনি দিল্লির বাদশার কাছে চিঠি লিখে বসলেন। যার মূল কথা ছিল, প্রাণনাথ পারিবারিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরপর তার বড় দুই ভাই রামদেব ও জয়দেবকে হত্যা করেন এবং সিংহাসন দখল করেছেন। উপরন্তু তিনি একজন অত্যাচারী এবং প্রজা নির্যাতনকারী জমিদার।
প্রাণনাথের ন¤্র-ভদ্র আচরণ ও বহুমূল্য উপহার পেয়ে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভুল ভাঙে। তিনি তাকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেন এবং মুঘল স¤্রাটের প্রতি তার ভালোবাসা ও আনুগত্যে খুশি হয়ে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই সঙ্গে তাকে পুনরায় সফলতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনার আদেশ দেন। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রাণনাথ স্থির করেন, তিনি ধর্মের জন্য একটা বড়সড় কিছু করবেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন বড় কৃষ্ণভক্ত। তাই রাজা উপাধি পাওয়ার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি নিজভূমে ফিরে আসার আগে বৃন্দাবন ভ্রমণের জন্য মনস্থির করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিরে গিয়ে তিনি ভগবান কৃষ্ণের একটি মন্দির নির্মাণ করবেন।
এই মন্দিরটি বিখ্যাত মূলত এর অভাবনীয় নির্মাণ শৈলীর কারণে। তিনতলা নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার অনন্যনিদর্শন। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, সারাদেহে বসানো পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। টেরাকোটার ফলক সমৃদ্ধ এই মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সব থেকে সুন্দর মন্দির। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত ভারতের এগারোতম আশ্চর্য নিদর্শন ছিল এটি। এর গায়ে লাগানো পোড়ামাটির ফলক বেশ উৎকৃষ্ট মনের, যা সমসাময়িক কোনো দালানে দেখা যায় না। তবে পোড়ামাটির ফলকগুলোর বিশেষত্ব আসলে অন্যখানে। এগুলো সাধারণ কোনো টেরাকোটার কাজ নয়। এর গায়ে লাগানো প্রত্যেকটা ফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছু ফলকে মুঘল আমলের চিত্র বর্ণনাও দেখা যায়। তবে এসব ফলকের উপস্থাপন ছিল অনন্য, যা অন্যান্য টেরাকোটার নিদর্শনে দেখা যায় না। এর স্তম্ভের কার্নিশে সমসাময়িক জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে মুঘল জীবন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। মুঘল সম¤্রাটদের শিকার ও কারুকার্য খচিত রথের দৃশ্যায়ন দেখা যায় এ ধাপে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনীর বিবরণ। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বর্ণিত আছে এই অংশে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বাকাসুর হত্যা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী স্থান পেয়েছে এই ধাপে। তবে এই ধাপের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক উপস্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনীসমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনীর লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন এই ফলকগুলো।
পোড়ামাটির অলঙ্করণ ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরে দেওয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মানুষের মূর্তি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর খোদাই করা ছোট-ছোট মূর্তি। চোখ মেললেই হারিয়ে যাবে মন। কৌতূহল জাগবে মনে। এমন কারুকাজ সত্যিই মনোরম। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণের সাধারণ যে চিত্র, তাতে চারদিকের ভিত্তি প্যানেলের নি¤œাংশে চিত্রগুলো সমান্তরালভাবে চারটি প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
ভিত্তির একটু উপরেই লতা-পাতার মধ্যে প্রস্ফুটিত গোলাপ এবং এর বিকল্প হিসেবে কোথাও চারটি ধাতুর পাতে ধাতব প্রলেপযুক্ত ডিজাইন স্তম্ভের কার্নিশে প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১৯৬০ সালে সরকারের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিভাগ এই মন্দিরকে প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। সেই থেকেই এই পুরাকীর্তি প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত হয়ে আসছে। তবে প্রাণনাথ রায়ের আনা কৃষ্ণমূর্তিটি কিন্তু এখন আর নেই। এক রাসযাত্রার সময় মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। পরে মন্দির পরিচালনা কমিটি ভারত থেকে নতুন মূর্তি এনে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনও রয়েছে।
কিভাবে যাবেন ॥ ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন ও আকাশ পথে দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সাধারণত ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশ্য দিবা ও নৈশ্যকালীন বাসগুলো ছেড়ে যায়। বাস সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে শ্যামলী পরিবহন, শ্যামলী এন্টারপ্রাইজ, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, নাবিল পরিবহন, এ আর ট্রাভেলস্, এস এ পরিবহন, কেয়া পরিবহন, স্লিপিংকোচ আরাফাত পরিবহনসহ আরও অনেক দিবা ও নৈশ্যকালীন বাসসার্ভিস। ননএসি এবং এসি বাস ভাড়া মান ভেদে ৬৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা থেকে বেশ কিছু বাস সারাদিনই দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। রয়েছে উন্নত ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তনগর একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
আকাশ পথেও রয়েছে যোগাযোগ সুবিধা। ৪টি বিমান সার্ভিসের বিমানগুলো প্রতিদিন ১২ বার ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে চলাচল করে। ঢাকা থেকে সৈয়দপুর আঞ্চলিক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিটের মতো। ভাড়া প্রকার ভেদে ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৫শ’ টাকা। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে সবক’টি বিমান সার্ভিসের দিনাজপুরগামী নিজস্ব পরিবহন রয়েছে।
কোথায় থাকবেন ॥ কান্তনগর মন্দিরের পাশেই রয়েছে নতুন গড়ে উঠা একটি পর্যটন মোটেল। এই পর্যটন মোটেলের রুম ভাড়া ১৫শ’ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা। দিনাজপুর শহরেও রয়েছে বেশ ভালো মানের কয়েকটি হোটেল। এরমধ্যে রয়েছে গনেশতলায় অবস্থিত হোটেল কনকর্ড, ইউনিট, চকবাজারে অবস্থিত হোটেল মৃগয়া, নিমতলা মোড়ে অবস্থিত হোটেল আল-রশিদ, মালদহপট্টিতে অবস্থিত হোটেল ডায়মন্ড-এ ও বি। স্টেশন রোডে অবস্থিত হোটেল কনিকা ও নিউ হোটেল। এসব হোটেলে ৮শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকায় রাত কাটানো যায়।
কোথায় খাবেন ॥ কান্তনগর মন্দিরের পর্যটন মোটেলই পাওয়া যায় উন্নমানের খাওয়া। এছাড়া মন্দির থেকে ২/৫ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য হোটেল ও রেস্তরাঁ।
সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর