ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২

নৌকার চ্যালেঞ্জ ধানের শীষের ভোটব্যাংক

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ২৭ মে ২০২৩

নৌকার চ্যালেঞ্জ ধানের শীষের ভোটব্যাংক

জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২

জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২। নির্বাচনী এলাকা নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট নিয়ে গঠিত আসনটি এককভাবে কোনো রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন দখলে রাখতে পারেনি। তবে এখানে বিএনপির আধিপত্যই বেশি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সারাদেশে মাত্র সাতটি আসনে জয়লাভ করে দলটি। সেই নির্বাচনেও এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপি থেকে। কাজেই এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ধানের শীষের ভোটব্যাংক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বলতে গেলে দোরগোড়ায়। আগামী বছরের জানুয়ারিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর শেষ হওয়ায় এখন থেকেই নির্বাচনী মাঠ গরম হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন বর্তমান সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান। নির্বাচনী এলাকায় তাঁর ব্যাপক প্রভাব থাকায় সবদিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। 
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ এক হাজার ১৭০ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ২৮০ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ আসনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে তৎকালীন নবাবগঞ্জ আজকের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট আসনটিও ছিল রাজশাহীর অধীনে। এই আসনে আওয়ামী লীগের খালেদ আলী মোহাম্মদ ৫৩ হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া জাসদের সাঈদ ম-ল পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ৬২৭ ভোট এবং ন্যাপ নেতা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন পেয়েছিলেন ১১ হাজার ১০৪ ভোট। এই নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৯৭ জন এবং ভোট কেন্দ্র ছিল ৬০টি।
দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এ সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন হলে সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন ন্যাপ ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন। নির্বাচনে তিনি ২৬ হাজার ৮৭ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্ব^ী আওয়ামী লীগের (আঃ মালেক) প্রার্থী ইয়াশিন আলী পেয়েছিলেন ২১ হাজার ৬৫৪ ভোট। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মালেক চৌধুরী ৬ হাজার ৪৫৯ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মমতাজ উদ্দিন পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৯০ ভোট। 
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী মীম ওবায়দুল্লাহ ২০ হাজার ৩৬৬ ভোট পেয়ে এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে মাত্র ৫৭ ভোটে হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট আফসার আলী। আফসার আলী পেয়েছিলেন ২০ হাজার ৩০৯। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ডা. সালাউদ্দিন আহমেদ ১৬ হাজার ৮৮১ ভোট, তোহর আহমেদ ১১ হাজার ৯৫৯ ভোট ও মমতাজ উদ্দিন ১ হাজার ৪৪১ ভোট পেয়েছিলেন। নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ৫১ হাজার ৫৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বিএনপির সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। আওয়ামী লীগের আফসার আলী পেয়েছিলেন ৩৮ হাজার ৯৪৫ ভোট, জামায়াতের মীম ওবায়দুল্লাহ ৩৭ হাজার ৯৭৭, স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেক বিশ্বাস ২১ হাজার ৭৩৬ ভোট, জাতীয় পার্টির আব্দুল হান্নান ৯৩০ ভোট ও আব্দুল মান্নান নামের এক প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬০৯ ভোট।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৭ হাজার ৬৭৩ ভোট পেয়ে আবারও নির্বাচিত হন বিএনপির সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল খালেক বিশ্বাস পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৩৫৮ ভোট। এ ছাড়া জামায়াতের মীম ওবায়দুল্লাহ ৩৩ হাজার ৩৫৬ ভোট, আব্দুল মালেক চৌধুরী ১০ হাজার ৪৫৬ ভোট, গণআজাদি লীগের বজলুর রহমান ৬১৬ ভোট ও গণফোরামের রেজাউল হক ২৮৯ ভোট পেয়েছিলেন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ৮৬ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে আবারও নির্বাচিত হন বিএনপির সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মু. জিয়াউর রহমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৪১১ ভোট। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ পেয়েছিলেন ৯ হাজার ৯৯১ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী খুরশিদ আলম বাচ্চু পেয়েছিলেন ৪৪ হাজার ৮১ ভোট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির সাদেকুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৩০৬ ভোট।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। নির্বাচনে এই আসনটিতে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন মু. জিয়াউর রহমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নতুন মুখ আমিনুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯৬৯ ভোট। এ ছাড়া কল্যাণ পার্টির ফেরদৌস আলম ৫৫৩ ভোট ও সিপিবির সাদেকুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৩৭৩ ভোট।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুহা. গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস ৯৩ হাজার ৫০৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী খুরশিদ আলম বাচ্চু পেয়েছিলেন ২৭ হাজার ৮৯৬ ভোট।  সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি আওয়ামী লীগ ধরে রাখতে পারেনি। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী আমিনুল ইসলাম ধানের শীষ প্রতীকে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী মু. জিয়াউর রহমান নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫২ ভোট। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ হাজার ৬৩৭ ভোট।
এদিকে, বিএনপির আমিনুল ইসলাম সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় এই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হলে চলতি বছরের গত ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মু. জিয়াউর রহমান ৯৪ হাজার ৯২৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ আলী সরকার পান ২৫ হাজার ৩৯৯ ভোট। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী খুরশিদ আলম (মাথাল) ১৪ হাজার ৩০৯ ভোট, জাকের পার্টির প্রার্থী গোলাম মোস্তফা (গোলাপ ফুল) ১ হাজার ৮৭০ ভোট, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক (লাঙ্গল) ৩ হাজার ৬১ ভোট, বিএনএফ প্রার্থী নবীউল ইসলাম (টেলিভিশন) ১ হাজার ৪৭৩ ভোট পান।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনী রাজনীতি। গত উপনির্বাচনে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহী মনোনয়নপত্র তুলে হঠাৎ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, নাচোল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের, গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন রেজা, ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাব্বুল হোসেন, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার, কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল আলম সৈকত জোয়ার্দ্দার, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হালিমা খাতুন এবং ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা ও বর্তমান সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, আসন্ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীককে জয়ী করার টার্গেট থাকবে সবার। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন শুধু আমি চাইব না, আরও অনেকেই চাইবেন। সুতরাং দল যেটা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা মেনে নিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করে যাব। 
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস বলেন, আগামীবার আমি দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে আশাবাদী। তবে শেষ পর্যন্ত আমি দলীয় মনোনয়ন না পেলে দলের জন্য, নৌকার জন্য এবং দলীয় প্রার্থীর জন্য কাজ করব।
এদিকে, গত নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলামের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় একটা অংশ আগামী নির্বাচনে তাকে আর দলীয় প্রার্থী হিসেবে চাইছেন না বলে জানা গেছে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির পছন্দের প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আছেন জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক মাসউদা আফরোজ হক শুচি। তিনি বলেন, দল নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্যই মনোনয়নপত্র তুলব। দল আমার ওপর ভরসা রাখবে বলে আমি শতভাগ আশাবাদী। মানুষ ধানের শীষে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন আমাকে। 
মাসউদা আফরোজ হক শুচি ছাড়াও সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম ও গোমস্তাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা বাইরুল ইসলামও এ আসনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে।
বিএনপির প্রভাবিত আসন হলেও এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবও কম নয়। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী মীম ওবাইদুল্লাহ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হলে আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হবেন ড. মিজানুর রহমান।

×