ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১

আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী পুরনোতেই আস্থা বিএনপির 

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২৬ মে ২০২৩

আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী পুরনোতেই আস্থা বিএনপির 

ফলের রাজা আম। আর আমের রাজধানী হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ

ফলের রাজা আম। আর আমের রাজধানী হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত মোট আমের সিংহভাগই উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামটি সাম্প্রতিককালের। ইতোপূর্বে এই এলাকা ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ এই জেলা। বাংলাদেশের মানচিত্রে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অবস্থান সর্ব পশ্চিমে। পূর্বদিকে রাজশাহী ও নওগাঁ, উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলা, পশ্চিমে পদ্মা নদী ও মালদহ জেলা এবং দক্ষিণে পদ্মা নদী ও মুর্শিদাবাদ জেলা (পশ্চিমবঙ্গ)। বাংলাদেশে বাঙালির ঐতিহ্য গম্ভীরা গান বলতেই সবার মানসপটে ভেসে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাম।

আমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনেই বইছে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বলতে গেলে দোরগোড়ায়। চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এ সংসদীয় আসনের রাজনীতি এরই মধ্যে জমে উঠেছে। নির্বাচনের প্রায় সাত মাস বাকি থাকতেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। পাড়া-মহল্লায় এখন ভোটারদের আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে কে পাচ্ছেন নৌকার টিকিট, আর কেই-বা হচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী। 
চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আসন চাঁপাইনবাগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসন। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১ সাল থেকে গত ছয়বারের নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমানে সমান বিজয়ী। আগের টানা তিনবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া সংসদ সদস্য থাকলেও পরের তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদল হয়েছেন তিনজন। বর্তমানে এ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে তৎকালীন নবাবগঞ্জ আজকের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ আসনে প্রার্থী ছিলেন তিনজন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. মইনউদ্দিন আহমেদ মন্টু প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে বিএনপির অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, ১৯৮৬ সালের তৃতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের ডা. মইনউদ্দিন আহমেদ মন্টু।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ এনামুল হক অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৮ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রতিদ্বন্বী প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন কানসাট আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানী। তিনি গণফোরাম ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকার প্রার্থী হন। 
সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরেই থেকে যায়। নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন মরহুম ডা. মইনউদ্দিন আহমেদ মন্টুর ছেলে বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫০ ভোট। 
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তত তিনজন প্রার্থীর কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের জনমত গঠনে কাজ করছেন সম্ভাব্য এসব প্রার্থী। তারা হলেনÑ বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক। এ ছাড়াও, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জিল্লার রহমানও এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে নৌকার টিকিট পেতে পাঁচজন নেতা তৎপর। প্রার্থী বেশি হওয়ায় শুরু হয়েছে জটিল সমীকরণ।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, এ আসনে আমি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গত চার বছরে স্কুল-কলেজ নির্মাণসহ এলাকার প্রচুর উন্নয়ন করেছি। ফলে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ব্যাপক জনসমর্থন আমার পক্ষে আছে। তাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি এ আসন থেকে নির্বাচন করতে চাই। তবে এক্ষেত্রে দলীয় সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। 
এদিকে, করোনাসহ বিভিন্ন দুর্যোগকালে সময়ে এ আসনের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ আলোচিত জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগে আমাদের পরিবারের বিশেষ অবদান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি সব দুর্যোগে জনগণের পাশে ছিলাম। আশা করি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। 
মনোনয়ন দৌড়ে থাকা শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমি এ এলাকার মানুষের আপদে-বিপদে পাশে ছিলাম। জনগণের সমস্যায় সব সময় এগিয়ে এসেছি, ফলে আগামী নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়নের বিষয়ে আমি আশাবাদী।  
এদিকে, বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, শিবগঞ্জ বিএনপির ঘাঁটি। এ আসনে দলটির প্রার্থী কে হবেন, তা প্রায়ই চূড়ান্ত। তাই দলটি অনেকটা নির্ভার। জানা গেছে, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া হবেন বিএনপির প্রার্থী। তবে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
জানতে চাইলে শাহজাহান মিয়া বলেন, দীর্ঘ ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দল-মত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। শিবগঞ্জ বিএনপির দুর্গ। এ আসনে আগামী নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হলে অতীতের মতো এ আসনে আমি আবারও জয়ী হব বলে আশাবাদী। 
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এ আসনের প্রার্থী হিসেবে ড. কেরামত আলীর নাম ঘোষণা করেছে। রাজশাহী মহানগর জামায়াতের আমির কেরামত আলী দুবার শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি ভেতরে ভেতরে তৎপরতা চালাচ্ছেন।

×