ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাসাইলে শতাধিক একর তিন ফসলি জমি এখন গভীর খাত

প্রকল্পের নামে চলছে মাটি লুট

​​​​​​​নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২২:২৭, ২৫ মে ২০২৩

প্রকল্পের নামে চলছে মাটি লুট

টাঙ্গাইলের বাসাইলে অনুমোদনহীন প্রকল্পের নামে এভাবেই চলছে মাটি লুট

অননুমোদিত লেকভিউ প্রকল্পের নাম ভাঙিয়ে দেদার চলছে মাটি বিক্রির জমজমাট ব্যবসা। অবৈধ ড্রেজারে মাটি উত্তোলন আর বিক্রির ফলে তিন ফসলি জমি নষ্ট হওয়াসহ বর্ষা মৌসুমে দেখা দিয়েছে এলাকায় ভাঙনের শঙ্কা। আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের এক আত্মা হয়ে পরিচালিত ওই মাটির ব্যবসায় জিম্মি হয়ে পরেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এরপরও মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতিবাদকারীদের মারধরসহ হুমকি ধমকির নানা অভিযোগ। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ না থাকায় এলাকায় মাটি কাটার নৈরাজ্য চালাচ্ছেন ওই মাটি ব্যবসায়ীরা। প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জমি হারিয়েও নীরব গ্রামের সাধারণ মানুষ। তবে বিভিন্ন দামে জমিগুলো কিনে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাদল এন্টারপ্রাইজ কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে ফসলি জমির মাটি কাটার ওই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দেখা গেছে বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের সায়ের নাকাছিম গ্রামে। বাদল এন্টারপ্রাইজের নামে লেকভিউ প্রকল্প আর মাটি উত্তোলনের কাজটি পরিচালিত হচ্ছে। কাজের অংশীদার বাদল এন্টারপ্রাইজের স্বত্ব¡াধিকারী বাসাইল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী শহিদুল ইসলামের ভাই কাজী বাদল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাশিল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা খান বাহাদুর উপজেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব পালনে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক। আওয়ামী লীগ বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলেও স্থানীয়দের মাঝে গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি ওই লেকভিউ নামক প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, তথাকথিত লেকভিউয়ের নামে কাশিল ইউনিয়নের নাকাছিম সায়ের মৌজার শতাধিক একর তিন ফসলি জমির মাটি ২০-৩০ ফুট গভীর করে কেটে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। দিনরাত মিলিয়ে চলছে পাঁচ শতাধিক ড্রাম ট্রাক।

ভুক্তভোগী ইউনুস মিয়া বলেন, শুনে আসছিলাম এখানে লেকভিউ নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এটি শুনেই শুরুতে অনেকেই জমি বিক্রি করেছেন। এখন দেখছি শুধু মাটি খনন আর বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমে ১০-১৫ ফুট ডেকু দিয়ে জমি কাটলেও এখন মাটি খননের জন্য ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে ৩০ থেকে ৫০ ফুট গভীর থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলনের প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই পাশের জমি ভাঙতে শুরু করেছে। গ্রামের মসজিদ, কবরস্থানসহ আবাদি জমি ভাঙনের শঙ্কা পরেছে। পার্টনারশিপের কথা অস্বীকার করেছেন উপজেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন এখানে চাকরি করি। লেকভিউ প্রকল্পের মালিক বাদল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী বাদল।

লেকভিউ প্রকল্পের এখনো অনুমোদন হয়নি বলে স্বীকার করেছেন কাজী বাদল। তিনি বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের কাজ চলছে। ক্রয়কৃত জমির মাটিই খনন করছেন তারা। জোরপূর্বক কারও জমি নেওয়া হয়নি। এছাড়াও প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করতে কাউকে কোনো ভয়ভীতি দেখানো হয়নি বলেও জানান তিনি।

বাসাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়া বলেন, মাটি উত্তোলনে ব্যবহৃত জমিগুলো দুই বা এক ফসলি। জমি বিক্রি বা শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়গুলো আমাদের না। এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন উপজেলা প্রশাসন বলে জানান তিনি।

বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার বলেন, লেকভিউ প্রকল্পের নামে জেলা প্রশাসন বরাবর তারা একটি আবেদন করেছেন বলে আমি জানি। অনুমোদন ছাড়া তারা কিভাবে মাটি উত্তোলন করছেন সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ব্রিফ করবেন বলে জানান তিনি।

বাসাইল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক আত্মা হয়ে মাটি উত্তোলন বিক্রি কাজ করছেন। দেশের কোথাও আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাত্মা হতে না পারলেও এই মাটি ব্যবসায় এক আত্মা হয়েছেন বাসাইল উপজেলার আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতৃবৃন্দ। তিনি বলেন, যার সুবাধে নাম সর্বস্ব লেকভিউ প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের। ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতেও কিভাবে এমপি সাহেব তিন ফসলি জমির মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করলেন ? তিনি আরও বলেন, বিনা অনুমোদনেই চলছে লেকভিউ প্রকল্পের মাটি উত্তোলন কার্যক্রম। প্রকল্পের নামে কাটা হচ্ছে তিন ফসলি জমির মাটি। দফায় দফায় প্রতিবাদ করার কারণে ইতোপূর্বে অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে ব্যবসায়ীদের তিন লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন উপজেলা প্রশাসন। আবার শুরু হয়েছে সেই মাটি বিক্রি। প্রথমে ভেকু দিয়ে মাটি বিক্রি শুরু করলেও এখন উত্তোলন করা হচ্ছে ড্রেজার দিয়ে। এতে এলাকায় যেমন দেখা দিয়েছে ভাঙনের শঙ্কা, অন্যদিকে মাটি বিক্রির জন্য ব্যবহৃত বড় বড় ড্রাম ট্রাকে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। দ্রুত অবৈধ এই কার্যক্রম বন্ধে দেশের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বেই অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার কথা দিয়েছিল। এখন আবার অভিযোগ পাচ্ছি রীতিমতো তারা বালু উত্তোলন বিক্রি করছে। ফসলি জমির বালু উত্তোলন বন্ধে দ্রুতই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

×