ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

কুড়িগ্রাম-১

আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন্দলে জর্জরিত

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:২১, ২ এপ্রিল ২০২৩

আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন্দলে জর্জরিত

আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন্দলে জর্জরিত

কুড়িগ্রামে জাতীয় সংসদের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিই বর্তমানে আওয়ামী লীগের দখলে। সদরের আসনটি দখলে নিয়েছে জাতীয় পার্টি। এই আসনগুলোতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠেঘাটে ভোটের উত্তাপ শুরু হয়েছে। চলছে আলোচনা- সমালোচনা। প্রার্থীর দোষ, গুণ, কোন দল থেকে কে পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন, কাকে মনোনয়ন দিলে জিতবে আবার কাকে মনোনয়ন দিলে হারবে- এমন আলোচনা এখন সর্বত্র।
মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পরিচিতি বাড়াতে নিজের ছবি সংবলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে সরগরম করে তুলছে ভোটের মাঠ। একইসঙ্গে মনোনয়নের জন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরও করছেন তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলোতে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রুপিং-লবিং। 
এক সময় কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন এবং জেলার তিনটি আসনেই দলের এমপি থাকায় মাঠে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্ত। একাধিক আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার সঙ্গে সরকার বিরোধী মনোভাবের কারণে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। 
আর জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড় দেবে-এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভোটের মাঠে তারাও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছেন। বিপুল ভোটব্যাংকের কারণে কোনো কোনো আসনে তাদের প্রার্থীরাও জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। 
নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-১ সংসদীয় আসন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন বিরতি ছাড়া তৃতীয় থেকে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনে একচ্ছত্র আধিপত্য রেখেছিল জাতীয় পার্টি। তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছন্দপতন ঘটে। আওয়ামী লীগের দখলে যাওয়া এই আসনটিতে আগামী নির্বাচনেও নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। 
তবে, দলীয় কোন্দল আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই অগোছালো আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন সরকারে থাকার কারণে স্থানীয় কিছু নেতার ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অনেকেই বেশ নাখোশ। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দলটির স্থানীয় ত্যাগী নেতাদের। 
বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আসলাম হোসেন সওদাগরের নানা কর্মকা-ে বহুবার আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। যার প্রভাব সর্বত্রই পড়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা।

সোনাহাট স্থল বন্দর চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ, সোনাহাট স্থলবন্দর হতে কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরগামী মহাসড়কের প্রশস্তকরণ এবং সড়কে বিদ্যমান ব্রিজ কালভার্ট প্রশস্তকরণ, নতুন কালভার্ট ও ব্রিজ তৈরিকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজের বিপরীতে সোনাহাট স্থলবন্দরগামী ধরলা-১, ধরলা-২ ব্রিজ নির্মাণ, ভূরুঙ্গামারীতে ব্রিটিশ ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের পাশে আর একটি ব্রিজ নির্মাণরত, ধরলা, দুধকুমার ও ফুলকুমার নদীর নাব্য ফিরাতে জরিপ ও খনন কার্যসহ দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এত উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে আওয়ামী লীগ আসনটিতে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন কুড়িগ্রাম-১ আসনটিতে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তবে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিএনপির প্রার্থী একাধিক না হলেও তাদের দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে দলটি। অবস্থা এমন কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। যদিও নির্বাচনে জামায়াতের ভোট বিএনপি প্রার্থীই পাবে এ আসনে। কারণ ভূরুঙ্গামারী এলাকায় জামায়াতের অবস্থান বেশ শক্ত। যদিও তারা প্রকাশ্যে রাজনীতি না করলেও গ্রামে-গঞ্জে তাদের নেতাকর্মীরা গোপনে কাজ অব্যাহত রেখেছে। 
প্রবীণ নেতা মরহুম শামসুল হক চৌধুরী (তৎকালীন গভর্নর) জন্মস্থান হওয়ায় ভূরুঙ্গামারী এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনে এই ভোটব্যাংককে আওয়ামী লীগ কাজে লাগায়।  বিগত নির্বাচনের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে এই আসনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির এ কে এম সহিদুল ইসলাম বাচ্চু।

১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ  কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের হাত ধরে আসন ফিরে পায় জাতীয় পার্টি। এরপর ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম, নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পতাকা ধরে রাখেন মোস্তাক। একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আসনটি নিজেদের দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন আসলাম হোসেন সওদাগর।
আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে সাবেক এমপি মোস্তাকের ওপরই ভরসা করছে দলটি। তৃণমূলে জনপ্রিয় সাবেক এই এমপির দলীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নিজের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে মনোনয়ন চাইব। সে অনুযায়ী কাজ করছি।
তবে জাপার একক প্রার্থী থাকলেও বড় দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে তরুণ প্রার্থীসহ একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন। যদিও দল দুটির মধ্যে একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি হয়ে অন্তর্কোন্দল দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন-ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের  চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী খোকন, নাগেশ্বরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম মাজু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক তরুণ চিকিৎসক ডা. মাহাফুজার রহমান উজ্জ্বল। 
তরুণ চিকিৎসক ডা. উজ্জল মানুষের জন্য কাজ করছেন দীর্ঘদিন থেকে। ছুটছেন গ্রামের পর গ্রাম। তিনি বলেন, জনগণ যদি একবার আমাকে সুযোগ দেয় তাহলে আমি মানুষের উন্নয়নের সব কাজ করব। 
নির্বাচনে প্রার্থিতা চাওয়ার বিষয়ে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী খোকন বলেন, পারিবারিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। তবে দল যাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেবে দলের স্বার্থে তার জন্য কাজ করব।
এদিকে বর্তমান এমপি ও নাগেশ্বরী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসলাম হোসেন সওদাগরের সমালোচনা করে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মোস্তফা জামান বলেন, বর্তমান এমপির দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জনসংযোগ তো দূরের কথা দলীয় কোনো কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন না। দুই মাস আগে দলীয় কাউন্সিল হলেও আজ পর্যন্ত তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেননি। তাকে আবারও মনোনয়ন দেওয়া হলে দলের ভরাডুবি হবে।

নিজের মনোনয়ন পাওয়ার দাবির প্রতি জোর দিয়ে মোস্তফা জামান বলেন, ‘আমি নিয়মিত জনসংযোগ করছি। মানুষের দ্বারে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। আমার প্রত্যাশা, দল তৃণমূলের কথা শুনলে আমি মনোনয়ন পাব এবং নৌকার জয় নিশ্চিত করতে পারব।
এদিকে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ’৯৬ নির্বাচনে জয়ী হয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ না করায় আবারও এই আসনে লড়বেন বলে জানা গেছে। যদিও রানার দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তার দল ও তিনি প্রার্থী তা নিয়ে ভাবছেন না। 
দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আসনে বিএনপির একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল চরমে। কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বসহ সাইফুর রহমান রানার একতরফা সিদ্ধান্তে অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফলে রানার সঙ্গে একাধিক তরুণ নেতার মনোনয়ন নিয়ে দরকষাকষি হতে পারে। ড্যাব নেতা ডা. মো. ইউনুছ আলী ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল রাজা দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সে লক্ষ্যে এই তরুণ নেতারা জনসংযোগেও অংশ নিচ্ছেন। 
সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা। এদিকে চরাঞ্চল অধ্যুষিত এই আসনে নিজেদের আধিপত্য দিন দিন বাড়াচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর বিজয়কে মাঠ পরীক্ষা হিসেবে নিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে এই আসনে গোলাম মোস্তফা মো. আনসার আলী রয়েল ও হাবিবুল্লাহ বেলালি মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দলটির জেলা সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান।

×