ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানবিক আগুনযোদ্ধা

নয়ন চক্রবর্ত্তী

প্রকাশিত: ০১:৫১, ২৪ মার্চ ২০২৩

মানবিক আগুনযোদ্ধা

দুর্ঘটনা দুর্যোগে, সবার পাশে সবার আগে

দুর্ঘটনা দুর্যোগে, সবার পাশে সবার আগে। এটি ফায়ারের স্লোগান। শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকতে নারাজ দেশের অগ্নিসেনারা। খবর এলে ঘণ্টা বাজা মাত্র ৩০ সেকেন্ডে প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে ফায়ার কর্মীরা। গতি, সেবা ও ত্যাগ এই তিন মূলনীতিকে অনুসরণ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা এদেশে অগ্নিকা-সহ যে কোনো দুর্ঘটনায় প্রথম সারাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বহুমুখী পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে গণমানুষের আস্থা আর নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

এজন্য জনগণ তাদের শ্রদ্ধা করে। সংস্থাটি সমাজসেবা ও জনসেবায় অবদানের স্বরূপ এবার স্বাধীনতা পুরস্কারও পাচ্ছে। গত বছর চট্টগ্রামে বিএম ডিপোর অগ্নিকা-ে ১০ সদস্য প্রাণ হারান। আরও ৩ সদস্যের খোঁজ মেলেনি। সে ১৩ জনকে অগ্নিবীর খেতাব দেয় সরকার। ওই বিস্ফোরণের ঘটনা এতটাই ভয়াবহ হয় যে, চট্টগ্রামের বিভাগের আওতাধীন বেশিরভাগ স্টেশনের সদস্যরা যোগ দেন অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলায়। ঢাকা থেকে ছুটে এসে কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন খোদ মহাপরিচালক। এবার সীতাকু-ের সীমা অক্সিজেন প্লান্ট ও সর্বশেষ একটি তুলার গুদামে আগুন নেভাতে ফায়ার কর্মীদের প্রাণপণ চেষ্টা দেখেছে বিশ^বাসী।
সরকারি এই সংস্থাটির রয়েছে নানা সংকট। এরপরও দুর্ঘটনা ঘটলে জানমাল রক্ষায় প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়েন ফায়ার ফাইটাররা। এ জন্য দিবারাত্রিই কাজ করতে হয় উচ্চপর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের। এক সময় কয়েকটি গাড়ি ও কিছু নামেমাত্র সরঞ্জাম ছাড়া কিছুই ছিল না এই বাহিনীর। যত সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে, তার সিংহভাগই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। ২০১৮ সাল থেকে একটু একটু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সংস্থার সক্ষমতা আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়।

শিল্প অধ্যুষিত চট্টগ্রামে এক সময় কোনো বড় দুর্ঘটনা রোধে তাদের সরঞ্জাম ছিল অপ্রতুল। এখন চট্টগ্রামে ২২ তলা ভবনেও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মোকাবিলায় উঁচু মইয়ের গাড়ি রয়েছে। তবে জনবলসহ বেশকিছু সরঞ্জাম ঘাটতি দূর করতে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে।
পুরো চট্টগ্রাম জেলায় ফায়ার স্টেশন রয়েছে ২৪টি। তবে জেলার বাইরেও বিভাগের সকল স্টেশন প্রস্তুত থাকে যে  কোনো দুর্ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়তে। তবে বিএম ডিপোতে কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকার বিষয়টি গোপন করায় তৎক্ষণাৎ আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ ও নিহত হন সংস্থাটির রেকর্ডসংখ্যক কর্মী। ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ৪৯৩টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৯৭টি। তন্মধ্যে ‘এ ’শ্রেণিভুক্ত ২৫, বি শ্রেণিভুক্ত ৫৪, সি শ্রেণিভুক্ত ১৬ এবং নদী ফায়ার স্টেশন রয়েছে ২টি।
চট্টগ্রাম সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২৪টি ফায়ার স্টেশন চালু হয়েছে। আর বারৈয়ারহাট ও কর্ণফুলী মডার্ন ফায়ার স্টেশন অতি শীঘ্রই অপারেশনাল কাজে যুক্ত হবে। এ জেলায় জনবল রয়েছে মোট সাড়ে তিনশ। সংকট বেশি মহানগরীর স্টেশনগুলোতে। যদিও এসব বিষয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য নেই ওভারটাইম কিংবা ফ্রেস মানি। জনবল না থাকায়, শহরে একাধিক স্থানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ছুটতে হয় বেশিরভাগ স্টেশনের কর্মীদের।

যে ফায়ার ফাইটাররা সকালে অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলা করে স্টেশনে ফেরে, তাদেরকে আবার দুপুরে ছুটতে হয় অন্য কোথাও দুর্ঘটনার খবর এলে। একটানা সারাদিন কাজ করার পরও পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কোনো ধরনের শিফট ছাড়াই একই টিমের সদস্যদের পরবর্তী উদ্ধার ও অগ্নি প্রতিরোধে ছুটতে হয়, যা অনেকটা মানবেতর। 

চট্টগ্রামে যে সব আধুনিক সরঞ্জাম আছে ॥ চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসে একসময় অপ্রতুল সরঞ্জাম ছিল। ফলে বেশ কষ্টসাধ্য হতো আগুন নেভাতে। তবে বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের ফায়ার স্টেশনগুলোকে পরিপূর্ণ করছে। এখন চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮০০ থেকে সাড়ে ৬ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার ১১৭টি গাড়ি রয়েছে। ১১ থেকে ২১ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার বিশেষ পানিবাহী গাড়ি রয়েছে ৭টি।

টোয়িং ভেহিক্যাল উইথ সিএএফএস পানিবাহী গাড়ি রয়েছে ৯টি, টার্ন টেবিল লেডার ১টি, টোয়িং ভিহিক্যাল ১৪৭, পাম্প ৩০৮, ফোম টেন্ডার ২টি, কেমিক্যাল টেন্ডার ১টি, ব্রিদিং এ্যাপাটোরেস টেন্ডার ১টি, অ্যাম্বুলেন্স ৩১টি, রেসকিউ কমান্ড ভিহিক্যাল ৫টি, এপিএল ১টি, ¯েœারকেল ২টি, ইমার্জেন্সি রেসকিউ টেন্ডার ৮টি, লাইন ইউনিট ৪টি, রেকার ভ্যান দুটি, হ্যাজমেট টেন্ডার ১টি। ফায়ার কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত বছর টহল ডিউটি থাকা অবস্থায় তারা ১২১টি অগ্নিকা-ে আগুন নির্বাপণে কাজ করেছেন, এছাড়া ৯১টি দুর্ঘটনায় তারা উদ্ধারকার্য সম্পন্ন করেছেন।
তবে অগ্নিনির্বাপণে চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসকে পানি সংকট, অপ্রশস্ত সড়ক এবং যত্রতত্র কেমিক্যাল গোডাউন ও প্রতিষ্ঠান এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ব্যাপক হ্যাজার্ডের সম্মুখীন হয়। এজন্য দ্রুত অগ্নিনির্বাপণে প্রতিবন্ধকতায় পড়েন তারা। 
সার্বিক বিষয়ে যা বলছেন কর্মকর্তারা ॥ চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক জানান, আমাদের ৫শ’ ফায়ার ফাইটারের পদ খালি রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে এ সংকট সমাধান শীঘ্রই হবে। মানুষ ১০ থেকে ১৫ তলা ভবন করে কিন্তু ফায়ার সেফটি রাখে না। এসব নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা নিলে ৫০ শতাংশ ঝুঁকি হ্রাস হয়ে যায়।

ভবন মালিকরা একটি বড় আকারের রিজার্ভট্যাংক করলে বিপদের সময় কাজে লাগে। তাহলে আশপাশে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা পাম্প বসিয়ে পানি নিতে পারি। কিন্তু এসব কেউ করেন না। ব্যবসায়ীরাও এসব করেন না। অথচ এসবের অভাবে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। সীতাকু-ে তুলার গুদামে আগুন নেভাতে গিয়ে দেখলাম প্রতিষ্ঠানটির পানির রিজার্ভার নেই, যার ফলে অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়েছে। আমাদের মুভ করতে হয়েছে। আমরা সন্ধ্যার মধ্যে আগুন নেভাতে পারতাম, যদি পর্যাপ্ত পানির সোর্স থাকত। 
মার্কেট কমিটির সঙ্গে মতবিনিয়ম করা হচ্ছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা জানান, অনেক মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ, শপিং মল, মার্কেটগুলোর কমিটির সঙ্গে আমরা সভা করা শুরু করেছি। তাদের জানিয়েছি রাস্তার পাশেই যাতে রিজার্ভার করে, যাতে আগুন লাগলে পানির সংকট না হয়। কোটি কোটি টাকা দিয়ে ব্যবসা করছেন, কিন্তু ১ থেকে ২ শতাংশ অগ্নি নিরাপত্তায় ব্যয় না করলে সকলের বিপদ এটি বোঝাচ্ছি। 
সূত্রে জানা গেছে, বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণে চট্টগ্রামে ৬৮ মি. টিটিএল (টার্ন টেবিল লেডার) সংযোজন হয়েছে, যা দিয়ে ২০ থেকে ২২ তলা পর্যন্ত ভবনের আগুন নির্বাপণে কাজ করা যায়। এছাড়া একটি ৫৪ মিটারের টিটিএল রয়েছে,  যা ব্যবহার করে ১৮ তলা ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা যায়। 
ফায়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শহরের সড়ক ও অলিগলিতে বড় হ্যাজার্ড হচ্ছে সড়কে দু’পাশেই। একপাশ থেকে বিপরীত পাশে টেনে নেওয়া বিদ্যুৎ লাইন, ডিশ, ইন্টারনেটের ক্যাবল। এ বিষয়ে সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক জানান, এসব তার ঝোলানো প্যাচানো ও ঘুরানো, এসবের কারণে আমাদের টিটিএল গাড়ির মই দিয়ে প্রশস্তভাবে কাজ করা যায় না। সড়কে তারগুলো যদি না থাকে তাহলে আমাদের উদ্ধারকার্য ও অগ্নিনির্বাপণে দ্রুত কাজ করা সম্ভব হয়।
বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি এক সময় চট্টগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ফায়ারকে যথেষ্ট আধুনিক করেছে। নিত্যনতুন সরঞ্জাম যুক্ত করেছে। আগে সুযোগ-সুবিধা এভাবে ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। ফায়ার কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন। কোনো ফায়ার সদস্য মৃত্যুবরণ করলে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। আর কল্যাণ তহবিল থেকে ডিজি মহোদয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। এছাড়া কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে দেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ডিজি মহোদয়ের তহবিল থেকে সৎকার ও দাফনকার্য সম্পন্নে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের চাকরিও দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সাহসিকতা, ঝুঁকি, উদ্ভাবনী এবং সেবার জন্য ৪ ক্যাটাগরিতে দুই ধরনের পদক দেওয়া হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক এবং রাষ্ট্রপতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক রয়েছে। 

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস 

×