ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

বালিয়াবাড়ি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নেই

মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:০৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বালিয়াবাড়ি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নেই

আব্দুল কদ্দুছ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির রক্তগাঁথা মহাকাব্য। মহাবিজয়ের এই মহাকাব্যের অসংখ্য নায়ক ইতোমধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্মুখ যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ ও শত্রুঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে আত্মঘাতী আক্রমণসহ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

তাদেরই একজন সদর উপজেলার স্বল যশোদল গ্রামের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল কদ্দুছ (৬৮)। মরহুম মো. ইয়াকুব আলী ও আজিতা বানু দম্পতির ছেলেমেয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান আব্দুল কদ্দুছ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। এ অবস্থায় তিনি স্বাধীন ভূখ- ও লাল-সবুজের পতাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চলে যান। পরে তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫নং সেক্টরে অসম সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করে দেশমাতৃকা হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আব্দুল কদ্দুছ বলেন, ১৯৭১ সালে আমি কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমিসহ এলাকার ৫-৬ জন যুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যেতে উদ্যোগী হই। পরে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে প্রশিক্ষণের জন্য আমরা ভারতে চলে যাই। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষ না করেই সঙ্গীয় সহপাঠীরা ভয়ভীতির কারণে ভারত থেকে এলাকায় ফিরে আসে। কিন্তু আমি ভারতের বালাহাট মইলাম অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান করি।

সেখানে থাকাকালে আমাকে রিক্রুটিং শেষে মেঘালয় রাজ্যের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। পরে যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর কলাকৌশলসহ গেরিলা প্রশিক্ষণ নেই। ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে আমিসহ ৩০-৩৫ জন গাড়িতে করে শিলং থেকে মেঘালয় রাজ্যে ফেরার পথে বালাট পাহাড়ে পৌঁছে দুর্ঘটনার শিকার হই। এ সময় গাড়ির ব্রেক ফেল করে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে তিনজন মারা যায়। আহত অন্যরা স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ সময় আমি মাথায় ও কোমরে মারাত্মক আঘাত পেলে আমাকে মইলাম ক্যাম্পের হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
তিনি বলেন, সেখানে ২৫ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হলে আমাকে সাব সেক্টর কমান্ডার মুসলেহ উদ্দিন ওরফে দ্বীন টেকেরঘাট মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁরই নেতৃত্বে তাহেরপুর থানা ক্যাম্পে একাধিকবার আক্রমণ চালানোসহ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই। এ ছাড়াও বিভিন্ন খ- খ- যুদ্ধে অংশ নেই। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ বলেন, সাব সেক্টর কমান্ডার মুসলেহ উদ্দিন ওরফে দ্বীনের অধীন যুদ্ধকালীন ক্যাম্প থেকে আমাকেসহ ১০ জনকে বাছাই করা হয়। আমাদের নিজ দেশে পাঠানো হলে হাওড়ের ইটনা উপজেলায় ফিরে আসি। সেখানে অবস্থানকালে কমান্ডার মাসুদ কাদিরের নেতৃত্বে ইটনার বিভিন্ন খ- খ- যুদ্ধে অংশ নেন।

পরে করিমগঞ্জের কিরাটনে তৎকালীন খুর্শিদ চেয়ারম্যানের বাড়ির অস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে আসি। সেখানে থেকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বালিয়াবাড়ি ব্রিজ ধ্বংসের আক্রমণে অংশ নেই। এ সময় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই।
আব্দুল কদ্দুছ বলেন, হাওড়ের অষ্টগ্রাম থানায় আক্রমণ করার সময় আমাদের সঙ্গী করিমগঞ্জের আনসার কমান্ডার আব্দুর রশিদকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা ধরে জেলা শহরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করে। এ খবরে আমিসহ অন্যরা ক্ষোভে ফেটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় আক্রমণ চালাই। এর আগেই পাকসেনারা থানা ছেড়ে পলায়ন করে। থানায় আক্রমণকালে নিজ হাতে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে থানার এক এসআইকে মেরে ফেলি। 
পাকসেনাদের হামলার ভয়ে সহপাঠীদের অনেকে আতঙ্কিত হলেও আমি বীরদর্পে সামনে এগিয়ে গেছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শত্রুনিধন প্রতিজ্ঞা নিয়েই যুদ্ধে যাই। আমরা হয় মরব, না হয় মারব। আমরা বেঁচে ফিরব, সে চিন্তা করিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ আক্ষেপ করে বলেন, জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সরাসরি শোনার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু যতদিন প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতি সংরক্ষণ না করা হবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও পূর্ণতা পাবে না। আর তাদের স্মৃতিকথা সংরক্ষণের কাজটি সরকারকে খুব দ্রুতই করতে হবে।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে কিশোরগঞ্জ ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্তঘাঁটি। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর সর্বপ্রথম ১৯ এপ্রিল (শুক্রবার) ট্রেনে করে হানাদার বাহিনী প্রথম কিশোরগঞ্জে ঢোকে। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী কিশোরগঞ্জ ছেড়ে চলে গেলেও তাদের দোসররা কিশোরগঞ্জে শক্ত অবস্থান ধরে রাখে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে উজ্জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জকে মুক্ত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ওইদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল কিশোরগঞ্জ শহরের চারপাশে সশস্ত্র অবস্থান নেন। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শহরের পূর্বদিক দিয়ে প্রথমে একদল মুক্তিযোদ্ধা কিশোরগঞ্জে ঢোকেন। এর পর পরই অন্যান্য প্রবেশপথ দিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে শহরে প্রবেশ করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানের খবরে মুক্তিকামী জনতাও উল্লাস করে স্বাধীনতার স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সামান্য প্রতিরোধের পরই পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসররা আত্মসমর্পণ করে।

monarchmart
monarchmart

শীর্ষ সংবাদ: