ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

৬০ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয় ২০ হানাদার

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

৬০ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয় ২০ হানাদার

খলিলুর রহমান খান

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার টানে সাড়া দিয়ে পশ্চিমাদের হাত থেকে নিজেদের ভূখ- স্বাধীন করতে পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুব সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
তাদেরই একজন মাদারীপুরের খলিলুর রহমান খান। যার বীরত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার নামে ‘খলিল বাহিনী’ নামে একটি চৌকস বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর নেতৃত্বে মাদারীপুরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ চলে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। 
এই বাহিনীর প্রধান দুঃসাহসিক বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২ মার্চ শাজাহান খান, তাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, বদিউজ্জামান বদু ও আমি নাজিমউদ্দিন কলেজের ফ্লাগস্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেই। এটা ছিল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মাদারীপুরবাসীর প্রথম প্রতিবাদ। মাদারীপুরের মানুষ আমাকে মেজর খলিল নামকরণ করেছিল।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এ বার্তা মাদারীপুর আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে যায়। এ সংবাদ মাদারীপুরের তৎকালীন টিঅ্যান্ডটি অপারেটর আবদুস সামাদ ও কাজী হাফিজুল হক টিঅ্যান্ডটির পিওন রেজ্জাক মিয়াকে পাঠিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান সিকদারকে জানান। পাকি বাহিনীর ঢাকা আক্রমণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ বাতাসের আগে পৌঁছে যায় সর্বত্র। 
অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান সিকদার এ সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য চলে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপিএ মৌলভী আছমত আলী খানের বাড়ি। এ সময় মৌলভী অছমত আলী খান তার ছেলে ছাত্রনেতা শাজাহান খানকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তারা ফণীভূষণ মজুমদারের বাড়ি গিয়ে তাকে এ সংবাদ অবহিত করে সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভূঁইয়ার বাড়ি থেকে সরোয়ার হোসেন মোল্লা ও বাচ্চু ভূঁইয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন। 
রাতে অছমত আলী খানের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির জরুরি সভা। সভায় তাৎক্ষণিক শহরে মাইক নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। মাইকিং করে সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে আহ্বান জানিয়ে সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়। ২৬ মার্চ সকালে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির লোকজন এসডিও’র বাসায় উপস্থিত হন (বর্তমানে ডিসি’র বাসা)।

তখন এসডিপিও মো. আবদুল মান্নানসহ উপস্থিত সকল বাঙালি অফিসার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মহকুমা প্রশাসকের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র-যুবকদের থানা ও ট্রেজারি থেকে রাইফেল সরবরাহ করে পুলিশ লাইন মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়।     
এর আগেই ছাত্রনেতা শাজাহান খান, হারুন মোল্লা, সরদার শাহজাহান, বাচ্চু ভূঁইয়া, সরোয়ার হোসেন মোল্লা, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান শিকদার, অ্যাডভোকেট আমজাদ আলী খান, অ্যাডভোকেট নূরুল হক, নূরুল আলম বাবু চৌধুরী, আবদুল মান্নানসহ (টুনু মান্নান) আরও বেশকিছু ছাত্রনেতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজৈর, টেকেরহাট ও মুকসুদপুর থানার দিগনগর ফেরি ডুবিয়ে ও ২/৩ কিমি ভাটিতে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। যাতে হানাদার বাহিনী ফেরি পার হয়ে স্থলপথে মাদারীপুরে প্রবেশ করতে না পারে।

১৭ এপ্রিল মাদারীপুরের ১৬৫ ছাত্র-যুবককে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এই দলের গাইড ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব। ২২ এপ্রিল পাকিবাহিনী বিমান থেকে মাদারীপুর মুক্তিযোদ্ধাদের লিয়াজোঁ অফিস শহরের মিলন সিনেমা হল এবং আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ি লক্ষ্য করে প্রথম গোলাবর্ষণ করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ওইদিন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২৪ এপ্রিল স্থলপথে বিনা বাধায় হানাদার বাহিনী টেকেরহাট ফেরি পার হয়ে সদর থানার মস্তফাপুর হয়ে মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করে।

টেকেরহাট থেকে তাদের বরণ করে আনে পাকি-বাহিনীর এ দেশীয় দোসর কুখ্যাত পিস কমিটির নেতারা। এ সংবাদে মাদারীপুর শহরের লোকজন পালাতে শুরু করে। হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করেই প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের এমপিএ আছমত আলী খান এবং মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার এমপিএর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে তারা জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র পুরান বাজারে প্রবেশ করে প্রথমেই মুকুন্দ লাল সাহাকে তার নিজ গদিতে বসা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। মুকুন্দ লাল সাহা হচ্ছেন জেলার প্রথম শহীদ। 
মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক তৎকালীন মহকুমা সাব-জেলার আবদুর রশিদ খান মাদারীপুর কারাগারের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে সমস্ত আসামি ছেড়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এ কারণে আবদুর রশিদ খানসহ এ পরিবারের ছয় জনকে টর্চার সেলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। হানাদার বাহিনী গোটা পরিবারকে হত্যা করে। মাদারীপুরের কুখ্যাত রাজাকাররা ওই পরিবারের ছয়জনকে ধরে এনে তাদের পশ্চিমা প্রভুদের হাতে তুলে দেয়। এরপর টর্চার সেলে নিয়ে মাসব্যাপী তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতে এক সময় টর্চার সেলের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তারা। 
সর্বশেষ আমাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর লড়াই হয় বর্তমান সদর থানার সমাদ্দার ব্রিজে। একটানা ৬০ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধ শেষে এক মেজরসহ ৫৩ পাকি সেনা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ৮ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় হানাদার বাহিনী গোলবারুদ, অস্ত্র ও কনভয়সহ তাদের বাঙালি দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঘটকচর ব্রিজ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আক্রমণ শুরু করি। 
মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বর্ষণে ভীত হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে হানাদার ও তাদের দোসরদের একটি অংশ সমাদ্দার ব্রিজের দুইপাশে পূর্বে তৈরি করা বাংকারে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। ৮ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা যুদ্ধ চলে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গোলাবারুদ স্তিমিত হয়ে পড়লে ১০ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হ্যান্ড মাইকযোগে আমি পাকি বাহিনীকে আত্মসর্পণের আহ্বান জানাই।

এতে সাড়া দিয়ে হানাদার বাহিনী রাইফেলের মাথায় সাদা কাপড় উড়িয়ে বাংকার থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার সিগন্যাল হিসেবে মিস ফায়ার করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বাংকার থেকে বেরিয়ে পাশের খাল থেকে পানি, গাড়ি থেকে শুকনো খাবার ও গোলাবারুদ নিয়ে পুনরায় বাংকারে ঢুকে গোলাগুলি শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে সন্ধ্যার আগেই হানাদার বাহিনীর মেজর আবদুল হামিদ খটক আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেন, ‘মেজর খলিল কো ভেজ দো’। 
মিত্রবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে মাদারীপুর শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে শহীদ হন মাদারীপুরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। তিনি শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে ফেরার পথে শহীদ হন। যুদ্ধে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তিনদিন দুইরাত বিরতিহীন সম্মুখযুদ্ধে ২০ হানাদার সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকি বাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মাদারীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিশ্চিত পরাজয় জেনে হানাদার বাহিনী ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মাদারীপুর থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

×