ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

শান্তির দূতকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকি সেনারা

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:১১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

শান্তির দূতকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকি সেনারা

আবু সুফিয়ান

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান। স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসএসসি পরীক্ষার প্রাক্কালে মায়ের অনুপ্রেরণায় প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। মেঘালয় রাজ্যের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে ৫ নং সেক্টরের চেলা সাবসেক্টরে ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

ছাতক-দোয়ারাবাজার উপজেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে একাধিক গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখসমরে মোকাবিলা করেছেন পাকি হানাদার বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধকালে ২২ অক্টোবর নারায়ণতলা যুদ্ধে পাকি সেনাদের ছোড়া বোমার স্পিøন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান বর্তমানে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আবু সুফিয়ান বলেন, ৭ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) ছাতক মুক্ত হলে পাকি সেনারা পিছু হঠে গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। সিলেট শহরে তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর কেন্দ্র করে লামাকাজিঘাট এবং গোবিন্দগঞ্জকে হেভি মেশিনগান, মিডিয়াম মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার এবং গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। সুনামগঞ্জের প্রতিটি থানা সদর থেকে পলায়নকৃত সৈন্যদের জড়ো করে হানাদার বাহিনী গোবিন্দগঞ্জে একত্রিত হয়।

শত্রুদের পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধারা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমগ্র বাংলাদেশ ভূখ- হানাদারমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথে বলিয়ান প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, ৫ ডিসেম্বর (রবিবার) টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত হয়। পরদিন ৬ ডিসেম্বর (সোমবার) সুনামগঞ্জ থেকে গভীর রাতে পাকি সেনারা পলায়ন করলে মুক্ত হয় জেলা সদর (তৎকালীন মহকুমা সদর)। ওইদিন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।

কারণ, ঐদিন বন্ধুরাষ্ট্র ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেকটি অবস্থানে। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ হানাদার মুক্ত হলে আমাদের কোম্পানিকে গোবিন্দগঞ্জে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী টেংরাটিলায় ১০ মুক্তিযোদ্ধা রেখে বাকি সবাই নির্দেশিত জায়গার উদ্দেশে রওনা করে। সকাল ১০টায় আমরা সুরমা নদী অতিক্রম করি। দোহালিয়া হয়ে কয়েকটি হাওড় পাড়ি দিয়ে ভুইগাঁও হয়ে  গোবিন্দগঞ্জের দক্ষিণে ভুরকি গ্রামে পৌঁছি বিকেল পাঁচটায়। 
৭ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকালে নিয়মিত রোল কলের সময় আমাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, কোম্পানির দশজন টেংরায় থাকবে। বাকি সবাই গোবিন্দগঞ্জে যাবে। নাস্তার পরই শুরু হলো যাত্রা। সঙ্গে রয়েছেন লে. রউফ (পরবর্তীতে লে. কর্নেল, বীরবিক্রম) এবং আমাদের কোম্পানি কমান্ডার উজির মিয়া। বিগত কয়েকদিনে সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ উপজেলা সদর ত্যাগ করে হানাদাররা পলায়নরত অবস্থায় গোবিন্দগঞ্জে জড়ো হয়। সর্বশেষ ছাতক থেকে ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গুটিয়ে নেওয়া হয়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনী মিলে গোবিন্দগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী বীরউত্তম চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নেন। বেতার বার্তায় মিত্রবাহিনীর কর্নেল রাজসিংকে অনুরোধ করেন সালুটিকর এলাকায় অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন নবীকে তাঁর ডালডা কোম্পানিসহ ছাতকে পাঠানোর জন্য।

সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন নুরুন্নবী খান সালুটিকর এলাকা থেকে রওনা হয়ে হেঁটে ছাতকে সেক্টর সদর দপ্তরে রিপোর্ট করেন। সেখানে অভিযান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা এবং দিকনির্দেশনা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী অবস্থান ছাতক থেকে ৭/৮ কিমি দূরে মুরাদপুরে মেজর মহসিনের বাঙ্কারে পৌঁছান। এই বাঙ্কারে বসে পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন আকবর ও লে. ফখরউদ্দিন, লে. মাহবুবসহ মিত্রবাহিনীর সমর নায়করা যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন।

মিত্রবাহিনীর ২৫ অসম রেজিমেন্ট এবং ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য মেজর ওয়াইপি সিংয়ের অধীনে প্রস্তুত হয়ে আছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের উত্তরে চাঁদপুর গ্রামে রয়েছে ইদ্রিছ আলীর কোম্পানি এবং দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে উজির মিয়া, শহীদ চৌধুরী, সুবেদার আফসারের কোম্পানি ও খোরশেদ আলমের কোম্পানি। এই পাঁচটি এফএফ কোম্পানির নেতৃত্বে রয়েছেন লে. রউফ।
তিনি বলেন, চার্লি কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মহসিনের কাছ থেকে ক্যাপ্টেন নবী শত্রুর অবস্থান এবং হাতিয়ার সম্পর্কে ধারণা নেন। এমতাবস্থায় সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে ক্যাপ্টেন নুরুন্নবী খানকে তাঁর কোম্পানি ও অন্য কোম্পানিগুলোর সহায়তায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিত্রবাহিনীর দুটি কোম্পানি আর্টিলারি এবং মর্টার ও হেভি মেশিনগান থেকে আক্রমণকারী দলকে ফায়ারিং সাপোর্ট দিয়ে যাবে। তিনদিক থেকেই শত্রুবাহিনীর অবস্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে।

প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে শুধু আদেশের অপেক্ষায়। ক্যাপ্টেন নুরুন্নবী খান হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন স্থানীয় পাকিস্তানী কমান্ডারকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেওয়ার। মেজর মহসিন, মেজর ওয়াইপি সিং এবং কর্নেল রাজসিংয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার পর সবারই সম্মতি পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন নবী একটি চিঠি ড্রাফট করে মেজর মহসিনসহ অন্য সেনা কর্মকর্তাদের দেখালেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর চিঠিটি চূড়ান্ত করা হলো।

অন্যদিকে তিন ফুট বাই দুই ফুট সাদা পতাকা তৈরি করা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে পতাকা ঝোলানোর জন্য বাঁশ সংগ্রহ করা হলো। পতাকাটি বহন করার জন্য চারজন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এলেও একজনকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। ১৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল সোয়া ১০টায় পতাকা দিয়ে লোকটিকে পাঠিয়ে রাস্তার কাছে উঁচুগাছে ওপি (অবজারভেশন পোস্ট) উঠিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন নবী। ওপির কাজ হলো, শক্তিশালী বাইনোকুলারের সাহায্যে সর্বক্ষণিক পতাকাবাহী লোকটিকে ফলো করা।

লম্বা বাঁশের আগায় পতাকাটি ঝুলিয়ে লোকটি ধীরে ধীরে পাকি বাহিনীর অবস্থানে পৌঁছলে পাকিস্তানিরা লোকটিকে ঘিরে ফেলেছে বলে জানায় ওপিরা। এক সময় পতাকাটি আর দেখা যাচ্ছিল না। পাকিস্তানিদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান সম্বলিত চিঠি ও পতাকাবাহী লোকটির বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা, সৈনিক এবং স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিল। সবাই পতাকাবাহী লোকের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও দূত ফিরে আসেনি। তখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না যে, লোকটিকে তারা আটক করেছে নতুবা মেরে ফেলেছে। কারণ, এসব নরপশুর কাছে দূতের সম্মান পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বিধায় এই সময় থেকে চূড়ান্ত আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেনা কর্মকর্তারা একমত পোষণ করেন। স্বাধীনতার পর জানা যায়, শান্তির এই দূতকে এক পাকি ক্যাপ্টেন ব্রাশফায়ার করে বুক ঝাঁঝরা করে দিয়োিছল।
তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিটি ভুরকি-নোয়াগাঁও গ্রামের উত্তরপাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। সারাদিন পাকিস্তানিরা থেমে থেমে গোলাগুলি করে আমাদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে তার জবাব দিচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন নবী, লে. রউফ, লে. ফখরউদ্দিন আমাদের কোম্পানির অবস্থানে এসে সকল মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখলেন।

সহজেই বোঝা গেল, গোবিন্দগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার একটি অভিযান পরিচালিত হবে আজ রাতে অথবা আগামীকাল। চলে গেলেন আমাদের অধিনায়করা, আমরাও আমাদের বাঙ্কারে চলে গেলাম। ডিফেন্সে সতর্ক পাহারায় রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল। ঘরের মধ্যে খড় বিছিয়ে শুয়ে আছি আমরা, কিন্তু উত্তেজনায় কিছুতেই ঘুম আসছে না।

কিছুক্ষণ পর পরই সহযোদ্ধাদের আনাগোনায় বুঝে নিলাম আজ রাতেই আক্রমণ পরিচালিত হবে। পাসওয়ার্ড জানিয়ে দেওয়া হলো ‘লতা আম’। কোম্পানি কমান্ডার উজির ভাই আমাকে জানালেন, আজ রাতেই গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করা হবে। বার্তাটি প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মজিদ ও একরামুল্লা সিকদারের মাধ্যমে সকল মুক্তিযোদ্ধার কাছে পৌঁছে যায়।
ভোর পৌনে চারটায় গোবিন্দগঞ্জ তেমাথার উত্তর-পশ্চিম দিক হতে মেশিনগান থেকে একটানা গোলাগুলি শুরু হয়। কিন্তু আমাদের কমান্ডার নীরব। এতে বুঝতে পারলাম আমাদের পক্ষ থেকেই গুলি ছোড়া হচ্ছে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সারাটা আকাশই মেশিনগানের গুলির আলোতে আলোকিত, ছুটে যাচ্ছে শত্রুর অবস্থানের দিকে। মিত্রবাহিনীর অবস্থান থেকে তিন ইঞ্চি মর্টার, আর্টিলারি থেকে গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে শত্রুসেনাদের অবস্থানে।

মনে হলো আজ গোবিন্দগঞ্জে আল্লাহর গজব নেমে এসেছে, সিগন্যাল পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হলে আমাদের পক্ষের সবাই গুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়। এভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নবীর ডালডা কোম্পানির সৈনিকরা তিনটি রকেট লঞ্চার থেকে ফায়ার শুরু করে শত্রুর বাঙ্কার লক্ষ্য করে। এতে পাকিসেনাদের বাঙ্কার গুঁড়িয়ে যায়। পাকিসেনারা বাঙ্কার ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী আক্রমণের মধ্যে তাদের পক্ষে বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব হলো না। প্রতিউত্তর না পেয়ে আক্রমণকারী দল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে শত্রুদের বাঙ্কার সার্চ করে। বটের খাল অতিক্রম করেই আমাদের কোম্পানিকে মেসেজটি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন নবী।

×