ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

কটিয়াদিতে ১৪৩ পাকি সেনাকে হত্যা করি

আব্দুর রউফ সরকার, রংপুর

প্রকাশিত: ০০:১২, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

কটিয়াদিতে ১৪৩ পাকি সেনাকে হত্যা করি

বীরপ্রতীক আকমল আলী

১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্পে হাবিলদার পদে কর্মরত ছিলেন কাজী আকমল আলী। অসীম সাহসী এই বীর মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩নং সেক্টর কমান্ডার এম সফিউল্লার নেতৃত্বে নয়টি মাস
সম্মুখযুদ্ধ করেছেন। তিনি একাই চার শতাধিক পাকসেনা হত্যা করেছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাকে সেক্টর কমান্ডার এম সফিউল্লার ‘ডান হাত’ বলেও অভিহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য কাজী আকমল আলী বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পে ছিল ১২০ জন পাঞ্জাবি এবং ২২০ জন বাঙালি সৈনিক। অফিসার ১০ জনের মধ্যে দুজন মাত্র বাঙালি। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা ৬০ জন বাঙালি সমমনা সৈনিক গোপন বৈঠক করি। সবাই পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করি- মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। সিদ্ধান্ত হলো, রাতে এই ক্যাম্প থেকেই আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে। একজন পাকিস্তানি সৈনিকও যেন বাঁচতে না পারে আমরা সেভাবে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নেই। পরিকল্পনা মোতাবেক আটজন কমান্ডারের নেতৃত্বে আটটি গ্রুপ তৈরি করা হলো। আর একটি মোবাইল গ্রুপ থাকে ব্যাকআপ সাপোর্টের জন্য। সিদ্ধান্ত হলো, প্রথম আক্রমণ হবে এমটি প্লাটুনে।

প্রথম ফায়ারের পরপরই সবাই একসঙ্গে আক্রমণে যাবে। পাকিস্তানিরা আমাদের আক্রমণের বিষয়ে কিছুই জানতো না। ফলে প্রস্তুতি না থাকায় তারা তেমন কোনো প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি। আমরা এই অপারেশন আমরা সফলভাবে সম্পন্ন করি। এই অপারেশনে ১২০ জন পাকিস্তানি সৈন্যের মধ্যে ১১৩ জন নিহত হয়। সাতজন আত্মসমর্পণ করলে তাদের গ্রেপ্তার করে আমরা ময়মনসিংহ থানায় হস্তান্তর করি। আমরা ক্যাম্পের সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম এবং গাড়ি নিয়ে দ্রুত ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে নরসিংদী পৌঁছে যাই। সেখানে ৩নং সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর (পরে সেনাপ্রধান) শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করি। 
মনোহরদী থানার পাকবাহিনী ক্যাম্পে ১৬ জন বাঙালি ইপিআর সৈন্য ছিল। আমার আপন বড়ভাই সুবেদার কাজী ওসমান চর মনোহরদী ক্যাম্পে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করছেন। পাকবাহিনীতে কর্মরত এক বাঙালি হাবিলদার মুজিবুর রহমান আমার বড় ভাইকে গোপনে তাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করান। ফলে পাক ক্যাম্পে সৈন্যদের অবস্থান, তাদের বাংকারসহ সকল তথ্য স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। ওই হাবিলদার মুজিবুর নিশ্চিত করলেন, আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তারা পাকবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এক জোট হয়ে লড়বেন।

ক্যাম্পে মোট ৯০ জন সৈন্যের মধ্যে ৬০ জন এবং ৩০ জন বাঙালি ছিল। আমি বিস্তারিত তথ্য নিয়ে সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করে আক্রমণের অনুমতি চাই। তিনি অনুমতি না দিয়ে বললেন, তুমি নিজ দায়িত্বে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নাও।
১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার কিছু আগে এক কোম্পানি গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে আমি গোপনে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রওনা হই। হাতে এলএমজি, এসএমজি, স্টেনগান ও রাইফেল। সঙ্গে মাত্র দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার ও দুটি মেশিন গান। সতর্কতার সঙ্গে পাকি ক্যাম্প তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলি। সম্পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ হলে সন্ধ্যার আগেই ক্যাম্পে আক্রমণ করি। প্রথমে বড় ভাই কাজী ওসমান আলী তিন ইঞ্চি মর্টার দিয়ে ৪৫-৫০ রাউন্ড ফায়ার করে মূল আক্রমণের সংকেত দেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি এবং আমার সৈন্যরা পজিশন ছেড়ে একযোগে গুলি করতে করতে ক্যাম্পে ঢুকতে থাকি। এক সঙ্গে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধদের অস্ত্র। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো মনোহরদী।

শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। সেদিন বেঈমানি করেনি পাকবাহিনীর বাঙালি ইপিআর ভাইয়েরা। যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র তারা আমাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। পাকবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কয়েক ঘণ্টার মরণপণ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হতে থাকলে একপর্যায়ে তারা পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। কিন্ত, একদিকে নদী, আমরা তিন দিক ঘিরে রেখেছি। বাধ্য হয়ে ১১ জন পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। বাকি ৪৯ জন পাকসেনা গুলি খেয়ে মারা যায়।

আত্মসমর্পণকারী ১১ জনের মধ্যে ছয়জনকে বিক্ষুব্ধ জনতা ছিনিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। আমরা যখন বাকি পাঁচজনকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, এক বৃদ্ধ পেছন থেকে এক জেসিওকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তার যুবক সন্তান হত্যার বদলা নেয়। ওই জেসিও নাকি তার যুবক পুত্রকে নির্যাতন করে পিটিয়ে মেরেছিল।
মনোহরদী থেকে মির্জাচর পৌঁছে আমরা নবীনগর দিয়ে যশতোয়া বাড়িখলা হয়ে ছতুরায় পৌঁছাই। সেখানে রাজাকাররা আমাদের উপস্থিতি টের পায়। সেটা পাকিস্তানীদের জানালে পুরো এলাকা রেড এলার্ট জারি হয়। পরে নিয়ামতপুর দিয়ে কসবার খড়েরার দিকে এগোতে থাকি। আমরা যেই কুমিল্লা বি-বাড়িয়া সিঅ্যান্ডবি রাস্তায় উঠি, তখনই আমাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু হলো। নূরুল ইসলাম এবং বন্দি এক পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি এবং রহিম লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে পজিশন নেই, আমাদের হাতে এসএমজি। বাকিরা পেছনে সরে গেল।

এ সময় আমরা জীবন বাজি রেখে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকি। গুলি খেয়ে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর ম্যাগজিন খালি না হওয়া পর্যন্ত ব্রাশফায়ার করতে থাকি। এর পর পাশের বাংকারে গ্রেনেড ছুড়ি। ওখান থেকে ইমামবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে আবার আমাদের ওপর আক্রমণ হয়। আমরা মনিয়ন্দর দিকে রওয়ানা দেই। মাঝরাতে মনিয়ন্দও পৌঁছে দেখি বিলের মধ্যে অসংখ্য বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলা অবস্থান করছে। তাদের কাছে জানতে পারি, শত শত পাকিস্তানী সেনা এলাকাজুড়ে সার্চ করছে। যাকেই সামনে পাচ্ছে, তাকেই মেরে ফেলছে।

এখন বর্ডার পার হওয়া বিপজ্জনক হবে ভেবে অপেক্ষা করিম। ভোরের দিকে ওই মহিলাদের সাহায্যে বর্ডার পার হয়ে প্রথমে হন্ডিয়ার হাপানিয়া ক্যাম্প ও পরে সিমলাতে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লার কাছে হস্তান্তর করি।
বীরপ্রতীক কাজী আকমল আলী আরেকটি অপারেশনের বর্ণনা দিয়ে বলেন,  মােনহরদী ক্যাম্পে ভয়াবহ পরাজয়ের পর পাকবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডো দল ভৈরব বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকে মনোহরদী আক্রমণ করার জন্য তারা আটটি লঞ্চ ও দুটি গানবোটের বিশাল বহর নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীপথে আসতে থাকে। পথিমধ্যে বেলাবো বাজারে মুক্তিবাহিনীর ছোট একটি দলের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। এতে কমান্ডার সুবেদার বাশারসহ সাত মুক্তিযোদ্ধার সবাই শহীদ হন। তখন আমরাও সিদ্ধান্ত নেই, ওদের গানবোট ও লঞ্চসহ পুরো বহরকে এমবুশ করে উড়িয়ে দেব। কটিয়াদির পাশর্^বর্তী রামপুরায় আমার দল নিয়ে অপেক্ষা করি।

আক্রমণের জন্য আটটি রকেট লঞ্চার সঙ্গে নেই। সারারাত বাংকার খনন করি। সকালে নদীর পাড়ে বাংকারে আমার সৈন্যরা ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। সকালের নাস্তা সেরে পাক সেনারা কটিয়াদি থেকে রওনা হয়। সমস্ত লঞ্চ গানবোট যখন আমাদের ফাঁদে, তখনই রকেট লঞ্চার দিয়ে গানবোট দুটিতে ফায়ার করি। বিধ্বস্ত গানবোট দুটি রেখে তারা তড়িঘড়ি করে পালিয়ে যায়। বৃষ্টির মতো গুলিতে শুরু হয় পাকসেনাদের আর্তনাদ, মরণ চিৎকার।

লঞ্চ, গানবোট ধ্বংস হয়ে যায়। এ যুদ্ধে পাক সেনাদের ১৪৩ জন নিহত হয়। কিছু সংখ্যক পালিয়ে যায়। এ ছাড়া বীর প্রতীক আকমল আলীর দল নরসিংদীর পাশে বাদুয়ার চর রেল ব্রিজ, রাজেন্দ্রপুর কাপাসিয়া সড়কে রাজাবাড়ি ব্রিজ এবং ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার অধিকাংশ ব্রিজ ও কালভার্ট উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

×