ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

তিনবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই

রামিজ আহসান, মেহেরপুর

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

তিনবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই

মো. আব্দুল মালেক

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে যাই, তখন একটাই চিন্তা ছিল দেশ স্বাধীন করতে হবে। আমরা স্বাধীন হব। ছাত্রজীবন থেকেই আমি রাজনৈতিক সচেতন। সমাজের নানা বৈষম্য আমার বিবেককে নাড়া দিত। রাষ্ট্রীয় বৈষম্যও মর্মপীড়া দেয়। সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন, তখন আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।

১৯৭১ সালে আমি মেহেরপুর সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন শুরু হয়ে যায়। তখন মেহেরপুর বয়েজ হাই স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করা হয়। সেই ক্যাম্পে অংশ নেই। অনেক দিন সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। পরে যশোর থেকে এসে পাক সেনারা যখন মেহেরপুর দখল করে, তখন আমরা এই ক্যাম্প থেকে সরে গিয়ে ইয়ুথ ক্যাম্পে যাই।

মেহেরপুরের প্রথম ব্যাচ হিসেবে আমি ভারতের বিহারে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেই। এরপর কৃষ্ণনগর এ্যাকশন ক্যাম্পে আসি। এ্যাকশন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলারা অবস্থান করতো এবং বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। এরপর অপারেশন করত, যুদ্ধ করত, ফাঁদ পাতত। কাজ শেষে আবার ওই ক্যাম্পে ফেরত যেত। এভাবে আমি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই।

গেরিলা যুদ্ধের মূল কৌশলই হচ্ছে হিট অ্যান্ড রান (আঘাত করো এবং পালিয়ে যাও)। সেসব দিনের স্মৃতিগুলো আজো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ছলছল করছিল মেহেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনারারি ক্যাপ্টেন (অব) মো. আব্দুল মালেকের।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউনিয়নের যতারপুর গ্রামে। এখন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়ামপাড়ায়। চার ভাই, চার বোনের মধ্যে সবার বড় মালেক। বাবা কৃষক। পরিবারে ছিল অভাব, অনটন। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখান তিনি।

মেহেরপুর সরকারি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন কৃষক পরিবারের সন্তান আব্দুল মালেক। বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধের পাশাপাশি গেরিলা হামলাও চালিয়েছেন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি ও আমার তিনজন সহকর্মী চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধা ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে ভর্তি হই। সেখানে ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন ইউনুস আলী। তার নেতৃত্বে আমরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের নদীয়ার কৃষ্ণনগরে যাই।

সেখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদের বিহারে নিয়ে যান। সেখানে অস্ত্র-গোলাবারুদ, গ্রেনেড চার্জ ও নিক্ষেপ, মর্টারশেল এবং মাইনস্থাপন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের শিকারপুর ক্যাম্পে যোগ দেই। সেখান থেকে আমরা যুদ্ধে অংশ নেই। বিভিন্ন স্থানে আমাদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হতো। কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধের মধ্যে ধর্মদাহ শিকারপুরে তিনদিন যুদ্ধ হয়েছিল।

যুদ্ধের একপর্যায়ে সেখানে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমরা বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছি। মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ানে সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে আমরা অ্যাম্বুস করেছিলাম। ওই অ্যাম্বুসে পাক হানাদার বাহিনী মুজিবনগর থেকে চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার দিকে যাচ্ছিল। আমরা হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালাই। সেই যুদ্ধে পাকসেনাদের অনেকেই হতাহত হয়। আমরা আঘাত করে আবার ক্যাম্পে ফেরত যাই। সেই সময় প্রথমে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী। পরে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এই সেক্টরের দায়িত্বে আসেন।
যুদ্ধের সময় অনেক ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হতো। তখন মাদার আলী বিশ্বাস পিস কমিটির নেতা ছিলেন। তিনি মা বাবাকে হুমকি দিতেন। বলতেন ছেলেকে ধরিয়ে দিতে, না হলে সবাইকে প্রাণ দিতে হবে। সেই ভয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারিনি ঠিকমতো। তিনবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি।
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এসএসসি পাস করার পরে অনেক ছোটাছুটি করেও চাকরি পাইনি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি সহজেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে পেরেছি। পরে কর্মদক্ষতা ও সততার কারণে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করি। দেশ স্বাধীন না হলে হয়তো আমি চাকরি পেতাম না। নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, যুদ্ধে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি সোনার বাংলাকে স্বাধীন করতে পেরেছি, আমরা একটি সুন্দর দেশ পেয়েছি।

×