ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ করি

অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর

প্রকাশিত: ০০:০১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩

ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ করি

বীরমুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ

মুক্তিযুদ্ধকালে ৬ অক্টোবর নূর মোহাম্মদ (ক্যাপ্টেন বাবুল) তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশন যুদ্ধে নয় ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর নিশ্চিত বিজয়ের মুখে পাকি হানাদাররা বিমান আক্রমণ করে। বিমান আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার ও ইসমত কাদীর গামা অসীম সাহসে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে কামার গ্রামের জাফর আলী খান ও বরাকের চরের জাহাঙ্গীর খান শাহাদাৎ বরণ করেন।

 নগরকান্দার মেজর আজিজ বিভিন্ন অপারেশনে তাকে সাহচর্য দেন। ক্যাপ্টেন বাবুল জানান, এই ওয়্যারলেস স্টেশন ছিল পাকি বাহিনীর একটি ঘাঁটি। আমার বাহিনী অসীম সাহসে যুদ্ধ করেছিল। আমরা যদি নিজেদের বিমান বাহিনীর সাহায্য পেতাম, তবে সেদিনই এই স্টেশন দখল করতে পারতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে তখন পর্যন্ত আমাদের কোনো বিমান বাহিনী ছিল না।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ১০ অক্টোবর ভেদরগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ হন সহযোদ্ধা সর্দার মহিউদ্দিন। যুদ্ধের পর মহিউদ্দিনের মরদেহ নিয়ে আমিসহ কয়েকজন যোদ্ধা যাই মহিউদ্দিনের বাড়িতে। বাড়ির আঙিনায় মহিউদ্দিনের মরদেহ রাখা হয়। মরদেহ দেখে তার ছোট বাচ্চা বার বার বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে শুরু করে, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে, তুমি চোখ মেলছো না কেন।’ ওই অবুঝ শিশুটিকে আমি সান্ত¡না দিতে পারিনি। কিন্তু আজো ওই শিশুটির করুণ আকুতি, অভিব্যক্তি আজো ভুলতে পারিনি।
১৪ অক্টোবর গোসাইরহাট থানার ডামুড্যায় শত্রুবাহিনীর সঙ্গে ছয় ঘণ্টা ভীষণ সম্মুখযুদ্ধ হয়। দু’পক্ষই এলএমজি ফায়ার ও মর্টারিং করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি মেজর, ক্যাপ্টেনসহ ৭৬ জন নিহত হয়। ক্যাপ্টেন বাবুলের সাব-সেক্টরের শহীদ আটজন মুক্তিযোদ্ধা হলেন আইয়ুব আলী, আছমত আলী মিয়া, খোরশেদ আলম, জাহিদুর রহমান, শেখ সালেহউদ্দিন, তাইবুর রহমান, লিয়াকত আলী খান ও আব্দুর রহমান। তারা ভেদরগঞ্জ থানার শাহজাহানপুর গ্রামে সমাহিত আছেন। 
নূর মোহাম্মদ বলেন, ২৮ নভেম্বর টুঙ্গিপাড়া গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য তাদের প্রতি দোয়া প্রার্থনা করি। তাদের লুণ্ঠিত কিছু জিনিস আমি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লুটের ওই ঘটনায় তার বাবা-মায়ের সামনে প্রতিবাদকারী ৮ জন বাঙালিকে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। আমি জানতে পেলাম আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
২৯ নভেম্বর রাত ১২টার দিকে ক্যাপ্টেন বাবুল কোটালীপাড়ার ঘাগর বাজারে ও গোডাউন এলাকায় হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেন। তিনদিন যুদ্ধের পর ২ ডিসেম্বর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করলে কোটালীপাড়া মুক্ত হয়। 
তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তুতি ও যুদ্ধ বিষয়ে জেনে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর সেলিম রাতের আঁধারে লঞ্চযোগে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু টেকেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনীর কাছে নিরুপায় হয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে ভোর ছয়টায় গোপালগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অস্ত্রসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সকাল সাতটায় আমরা গোপালগঞ্জে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি।
১৪ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মারফত জানা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত। বাবুলের রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা, পরিচালনা সর্বোপরি দলের নিষ্ঠা ও সুশৃঙ্খলাবোধে উজ্জীবিত সহযোদ্ধা ও রণক্ষেত্রের উদ্বেলিত জনতা তাকে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। 
১৪ ডিসেম্বর এলাকার ১০ থেকে ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধাসহ ক্যাপ্টেন বাবুল উপস্থিত হলেন ভাঙ্গা ডাকবাংলোতে। ওখানেই তিনি ফরিদপুরে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।  
মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন নূর মোহাম্মদ। ‘ক্যাপ্টেন বাবুল’ নামে বিখ্যাত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলকেই পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করেননি, ঘনিষ্ঠ সহচরদের একজন হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একাত্তরের অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ধাপে ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও কাজ করে গেছেন। শপথ নেন সশস্ত্র বিপ্লবে দেশ স্বাধীনের। যার কারণে ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫ নম্বর আসামিও। 
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। ২৬ মার্চ সকালে ফরিদপুর পুলিশ কন্ট্রোল ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পেয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ আওয়ামী লীগের নেতারা মাইকযোগে শহরজুড়ে প্রচার করেন। আমি ২৯ মার্চ লৌহজং থানা থেকে ১০টি রাইফেল সংগ্রহ করে ৩০০ যুবককে শারীরিক ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দেই।

পরে ভারতের আগরতলা ও মেলাগড়ে গিয়ে ২নং সেক্টরের মেজর খালেদ মোশারফ ও কর্নেল শওকত আলীর সঙ্গে আলোচনায় কিছুটা উজ্জীবিত হই। ওখান থেকে দ্রুত ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কাছে চলে যাই। মেজর জলিল আমাকে ৯০০ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার এক বিশাল দল নিয়ে ফরিদপুর সাব সেক্টর কমান্ড করতে পাঠান। এই বিশাল গুরুদায়িত্বের দায় মাথায় নিয়ে ফরিদপুর ফিরে এলাম।  
তিনি বলেন, অনেকটা নিরাপদ ভেবে ঘাঁটি গাড়লাম বৃহত্তর ফরিদপুরের কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দি গ্রামের স্কুলে। এটাই সামরিক ভাষায় আমার রিয়ার হেডকোয়ার্টার। এখানে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব নিলেন ডা. এসএ মালেক। রণাঙ্গনের সংবাদ কাভারে আমাদের সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক পল ও ফ্লেয়ার। ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর মজবুত বাঙ্কারের শক্ত ঘাঁটিতে আমি তিনবার আক্রমণ চালাই। এসব যুদ্ধে ছিলেন ইসমত কাদির গামা, হেমায়েত তালুকদার ও খন্দকার মুরাদের মতো বাহিনী কমান্ডাররাও। এরপর আমাদের দল ১০ অক্টোবর ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ ও দখল করে নেয়। 
ফরিদপুর শহরের এক নম্বর গোয়ালচামট মহল্লার বাড়িতে বসবাস করেন ৮৯ বছরের নূর মোহাম্মদ। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি সে বাড়ির একটি কক্ষে গড়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘর। এ জাদুঘরে তার নিজেরসহ বহু মুক্তিযোদ্ধার দুর্লভ ছবি রয়েছে। রয়েছে ওই সময়কার জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকদের ছবি।
নূর মোহাম্মদের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামে। তার বাবা মরহুম আলহাজ তমিজউদ্দিন, মা মরহুম রাবেয়া খাতুন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি হলেন দ্বিতীয়।

×