ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিজানুর রহমান মজনু

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ০০:৩১, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

মিজানুর রহমান মজনু

সাইকেলে করে ফেরার পথে রাস্তার দুপাশে গণহত্যার ভয়াবহ আর হৃদয়বিদারক সব দৃশ্য চোখে পড়ে। তিনি দেখলেন, রাস্তার দুপাশে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ। আর এর মধ্য দিয়েই অনেকটা পথ এগোতে হলো। একটা নারীকণ্ঠের কাতর আর্তনাদ কানে আসে। সে একটু পানি খেতে চায়। কাছে গিয়ে দেখলাম তাকে। এরপর রাস্তার পাশ থেকে কচুপাতা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে করে পানি এনে মেয়েটার মুখে ধরি। তখনই চোখে পড়ে, মেয়েটার কোলে একটা মৃত শিশু আঁকড়ে আছে। হয়ত তখনো জানে না তার বাচ্চাটা মরে গেছে। এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর মিছিল পেরিয়ে চলতে হয়েছে যুদ্ধের সেই কঠিন সময়।
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনেছি- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঐতিহাসিক এ ভাষণ শোনার পর থেকেই ভাবতে শুরু করি, দেশ ও জাতির জন্য কিছু একটা করতে হবে। আর বসে থাকার সময় নেই। দেশ ও জাতিকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে হলে যুদ্ধে যেতেই হবে।

যেই কথা সেই কাজ। ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেই শত্রুর মোকাবিলা করতে। ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখনকার টগবগে যুবক টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মিজানুর রহমান মজনু।
তিনি আরও বলেন, একটি জাতির জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অনুগ্রহ কিংবা দানের বিষয় নয়। বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
জানা যায়, ১৯৫৪ সালের ২ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মিজানুর রহমান মজনু জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নওশের আলী সরকার ও মাতার নাম হালিমা বেগম।

পরিবারের সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি শুধু নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, অন্যদের উৎসাহিত করে দলবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য পাড়ি জমান ভারতের তুড়া পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি যোগ দেন দেলবর আনসারীর ৯ নং আলফা কোম্পানিতে। তার কোম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ড (টুআইসি) ছিলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার খোরশেদ আলম ও প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সোহরাব হোসেন।

ভারতীয় বিহার রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত থাকা ৯ নং আলফা কোম্পানি ১১ নং সেক্টরের যাত্রাকোনা, চরবাঙ্গালী, হালুয়াঘাট, সর্চাপুর, তেলিখালী, ফুলপুর, তারাকান্দা, ময়মনসিংহ, সাভার, টঙ্গী ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এতে মিজানুর রহমান মজনুর ভূমিকাও অগ্রগণ্য।
সাহসী ও তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন যোদ্ধা হিসেবে কোম্পানিতে তার বেশ সুনাম ছিল। তাদের ১১নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন প্রথমে কর্নেল আবু তাহের পরবর্তীতে এম হামিদুল্লাহ খান। আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে ছিলেন ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্মরণীয় দিন মিজানুর রহমান মজনুর নিকট। এই দিনে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার চরবাঙ্গালী যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

কিন্তু তার সহযোদ্ধা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঝিঁনাইচর গ্রামের আবু সাঈদ হানাদার বাহিনীর ছোড়া গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ আবু সাঈদের তাজা রক্তে মিজানুর রহমান মজনুর শরীর ভিজে রক্তাক্ত হয়েছিল। সে দৃশ্য আজও তার চোখে ভেসে ওঠে এবং তাকে কাঁদায়। শহীদ আবু সাঈদকে পার্শ্ববর্তী ধলা পানি গ্রামে কবর দেওয়া হয়। এই যুদ্ধে বাসাইল উপজেলা ইউনুস আলী, জীবন করিম, কালিহাতী উপজেলার আনোয়ার হোসেন খান, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আব্দুস সবুর নামের কয়েকজন সহযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

এ ধরনের অনেক দৃশ্য ও সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি যখন স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখ- হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় তখন অন্য আট-দশ জন মুক্তিযোদ্ধার মতো তিনিও আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন, ধরে রাখতে পারেননি আনন্দ অশ্রু। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে আসেন ঘরে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হয়ে যান পুরো উদ্যমী।
তিনি মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীনের পর শুধু আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে মিজানুর রহমান মজনু তাদের সেবা করার দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কালিহাতী উপজেলা কমান্ডের কমান্ডার পদে বিপুল ভোটে দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত করেছেন। এখন তার দিনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় হয় মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।

কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কায়েম উদ্দিনের ছেলে মনিরুজ্জামান মনির বলেন, আমরা শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে সকল প্রকার সুযোগ- সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এবারই প্রথম মজনু কাকার একান্ত প্রচেষ্টায় সরকারি সম্মানি ভাতা পেয়েছি। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গাজী মাহমুদ বলেন, মিজানুর রহমান মজনু ১৯৭১ সালে যেমন অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করেছেন তেমনি এখন আমাদের (কালিহাতীর মুক্তিযোদ্ধাদের) পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছেন। ৯ নং আলফা কোম্পানি কমান্ডার দেলবর আনসারী মিজানুর রহমান মজনু সম্পর্কে বলেন, তিনি আমাদের কোম্পানির একজন দুঃসাহসিক যোদ্ধা। রণকৌশল নির্ধারণে মজনুর মতামত সর্বদাই গুরুত্ব পেত।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান মজনু বলেন, দেশ স্বাধীন হলেও এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক প্রাপ্য সম্মান, অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক স্থানে অবহেলিত, নিগৃহীত। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের কতিপয় পদক্ষেপ খুবই প্রশংসনীয়।

জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীনতা বিরোধীর জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেইসব ভয়াল স্মৃতি বর্তমান প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে পরাজিত শত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠিত হোক, তারা ভালো থাকুক এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সর্বদাই নিবেদিতভাবে কাজ করে যাব।

×