ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

হাদিউজ্জামান হাদি

তপন কুমার খাঁ, জয়পুরহাট থেকে

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

হাদিউজ্জামান হাদি

হাদিউজ্জামান হাদি

হাদিউজ্জামান হাদি ’৭১ এর রণাঙ্গনের এক যোদ্ধা। দেশমাতৃকার ডাকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি সেনা শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। ভয় বা পিছুটান কোনোকিছুই তাকে থামিয়ে দেয়নি। ১৭/১৮ বছরের কিশোর যার মধ্যে যুদ্ধ নামক কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু তার মনকে গড়ে তোলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে তৎকালীন জয়পুরহাট মহকুমার অন্তর্গত পাঁচবিবি থানার আয়মা রসুলপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে চলে আসেন।

বাড়িতে এলে বাবা মার ৫ সন্তানের প্রথম পুত্র কিশোর হাদিউজ্জামান হাদি দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। কৃষিজীবী পিতা আয়েন উদ্দিনকে বিষয়গুলো চমকে দেয়। ছেলের কথায় বাবাও বিষয়টি ভাবতে শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে ৭মার্চের ভাষণ চারদিকে মানুষের মনে জাগরণ তোলে। ছেলের কথায় বাবা-মা আলোচনা করে, তাই তো দেশে তো কিছু একটা হবে মনে হচ্ছে। শেখ মুজিদের ভাষণে সেই কথায় পাওয়া যায়। মার্চ চলে যায় এপ্রিলও শেষ হয়।

এমন একদিনে বাবা-মা কিশোর হাদিউজ্জামান হাদির সঙ্গে আবারও দেশ নিয়ে এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে পুত্র হাদিউজ্জামান হাদিকে বলেন, তুমি যদি যুদ্ধে যেতে চাও, তাহলে যাও। যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথাগুলো মনে রেখে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসো। ঢাকায় বাঙালি পুলিশ ও ছাত্রদের পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করছে কিন্তু যুদ্ধ কার সঙ্গে হচ্ছে এমন বিষয়টা তখনো হাদিউজ্জমানা পিতার মনে দানা বাঁধেনি।

কিন্তু নানাভাবে বিভিন্ন খবর পেয়ে এবং মানুষের উত্তেজনা দেখে আয়েন উদ্দিনের মনে দানা বেঁধে ওঠে। হ্যাঁ যুদ্ধই শুরু হবে এবং সেই যুদ্ধেই ছেলে হাদিউজ্জামানকে পাঠাবেন তিনি। সেই অনুযায়ী হাদিউজ্জামান যুদ্ধে যায়। বাড়ির অদুরেই ভারত, সেই ভারতের সীমান্ত দিয়েই এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চলে যায় হাদি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিকটবর্তী চেঙ্গিসপুর গ্রামে চলে যায় এবং সোবরা গ্রামে (ক্যাম্প) মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা জানালে যথারীতি তাকে ক্যাম্পে যুক্ত করে নিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়।

৯০ দিনের ট্রেনিং চলে ভারতের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডুগির নেতৃত্বে। ৩শ’ জন কিশোর তরুণদের প্রাথমিকভাবে হালকা অস্ত্রের মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। ট্রেনিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধাদের মনবল তৈরির নানা পরামর্শও দেওয়া হয়। জুন মাসের মাঝামাঝি পাশের গ্রাম কামারপাড়া গিয়ে যুদ্ধের দায়িত্ব নিয়ে অপারেশনে আসে হাদিউজ্জামান হাদি, মুক্তিযোদ্ধা সুমেল, বাবলু, এনড্রিও, ছাত্তারসহ ১৫ জন। তারা প্রথমে পাঁচবিবি থানার ভারত সীমানা সংলগ্ন কড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করে।

কড়িয়া গ্রামের ইপিআরের কোম্পানি হেড কোয়ার্টার থাকলেও ওই সময় পাকিস্তানি ইপিআরের সৈন্যরা না থাকায় তাদের কড়িয়া বাজারে প্রবেশ করতে সুবিধা হয়। এ সময় তারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কড়িয়ার আব্দুল জোব্বার ম-লের বাড়িতে কিছুক্ষণ অবস্থান করে কড়িয়া বাজারে ঢোকে। মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারের গোয়েন্দা সূত্রের প্রাপ্ত খবরে এক বিহারি যুবকের সন্ধান পায় হাদিউজ্জামানের টিম। ওই বিহারি যুবক বাঙালিদের উপর অত্যাচার করেছে এমন তথ্যের সত্যতা থাকায় তারা তাকে হত্যা করে।

অপারেশনের প্রথম দিন তারা সফল অপারেশন করে ফিরে যায়। কামারপাড়া ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে অপারেশন সফলের খবর দিলে তাদের উৎসাহিত করে ক্যাম্প কমান্ডার এবং পরবর্তী অপারেশন পাগলা দেওয়ানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জয়পুরহাট সদর থানার ধলাহার ইউনিয়নের পাগলা দেওয়ান গ্রামে ইপিআরের আর এক কোম্পানি হেড কোয়ার্টার হওয়ায় ক্যাম্পটিকে ধরে পাগলা দেওয়ান লক্ষ্যস্থল করা হয়। নানা অপারেশনে সেইভাবে কাজ চলে।

পাগলা দেওয়ান ও শিয়ালা দুটি এলাকা পাগলা দেওয়ান সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় এই পথে জয়পুরহাটসহ দেশের নিকটবর্তী লোকজন পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে নিরাপদে ভারতে যাওয়ার জন্য এই পথটিকে বেছে নেয়। আর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য পাগলা দেওয়ানকেই বেছে নেয়। পাগলা দেওয়ানের এই পথে জয়পুরহাট ছাড়াও বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, গাইবান্ধা, মানিকগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল এলাকার কয়েক হাজার ভীত সন্ত্রস্ত নারী, পুরুষ, শিশু জীবন নিয়ে পাগলা দেওয়ান দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য এলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের নির্বিচারে হত্যা করে।

পাকিস্তানি সৈন্যরা এই পাগলা দেওয়ানে একটি শক্তিশালী ঘাঁটিও তৈরি করে। পাকিস্থানি সৈন্যদের পাগলা দেওয়ান হত্যাকান্ডের খবর কামারপাড়া ক্যাম্পে পৌঁছুলে ক্যাম্প কমান্ডার এই এলাকাকে পরবর্তী বিভিন্ন অপারেশনের জন্য চিহ্নিহ্নত করে। সেই অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হাদিউজ্জামান হাদি ও তার দলকে পাগলা দেওয়ান অপারেশনে পাঠায়। সম্মুখযুদ্ধে এখানে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করা হয় এবং তাদের অস্ত্র দখল করা হয়।
সফল অপারেশন শেষে এই টিমকে জুলাই মাসের দিয়ে শিয়ালা গ্রামে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। এখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তারা যুক্ত হয়। ৩০মিনিটের যুদ্ধে ১৫/১৬জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হলেও হাদিউজ্জামান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাদিউজ্জামান হাদি বেপরোয়াভাবে দাড়িয়ে তার স্টেনগান দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের দিকে গুলি চালাতে চালাতে এক পর্যায়ে পড়ে যায় এবং জ্ঞান হারায়।

এ সময় প্রদীপ কর নামে দলের অপর যোদ্ধা হাদিউজ্জামানকে কাঁধে করে নিয়ে ক্রলিং করে নিরাপদ দুরত্বে চলে যায়। অন্যরা এই সময় নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নেয়। হাদিউজ্জামান হাদির জ্ঞান ফিরলে রক্তাক্ত শরীর দেখে প্রদীপ করসহ অন্য সাথীদের বলে আমার কি হয়েছে। তার গুলি লেগেছ এ কথা বলে তাকে একটি কাঠের তক্তার মত ট্রেচারে করে ভারতের কামারপাড়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে বলে তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।

আমি তো মনে হয় মরে যাব। আমি তো শেষ যুদ্ধ করতে পারলাম না। দেশ স্বাধীন করতে পারলাম না। তোমরা আমাকে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটা গাও। আমি গানটা শুনতে শুনতেই যেন মারা যাই। আমার লাশটা আমার বাবা মা’র কাছে সুযোগ থাকলে পাঠিয়ে দিও। জাতীয় সঙ্গীত শুনতে শুনতেই আবারও হাদিউজ্জামান অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গুলি তার শরীরের ভেতর না থাকলেও ডান দিকের ঘাড়ে গুলি লাগায় জায়গাটা ক্ষত বিক্ষত হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রায়গঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এক মাস রায়গঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরও সেরে না ওঠায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পুনে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। প্রায় দুই মাস পুনেতে চিকিৎসার পর তাকে কামারপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।

এই সময়কালে পাঁচবিবি ও জয়পুরহাটের কয়েকটি জায়গায় কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেয় হাদিউজ্জামান হাদি। এভাবে বিভিন্ন অপারেশনের পর ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে পাগলাদেওয়ান এলাকা দিয়ে জয়পুরহাটে বিজয়ের বেশে প্রবেশ করে হাদিউজ্জামান হাদিসহ তার দল এবং বিজয় পতাকা উত্তোলন করে।

×