ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভূয়া রোগী দেখিয়ে বছরে হরিলুট ৩৭ কোটি টাকা

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

ভূয়া রোগী দেখিয়ে বছরে হরিলুট ৩৭ কোটি টাকা

টাকা আত্মসাৎ

সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দপ্তরে  ভুয়া রোগী বানিয়ে সাহায্যের নামে বছরে লুটপাট হয়েছে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা। এভাবে চলছে ১০ বছর ধরে। ঘরে ঘরে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ ও থ্যালাসেমিয়া হাজার ভূয়া রোগী পেয়েছে সহায়তা। অথচ বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথরভাঙ্গা শ্রমিকে প্রাণঘাতি সিলিকোসিস রোগী সহায়তা নেই সমাজ সেবার। এমন কী প্রকৃত দরিদ্র জন্মগত ক্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু মিম সহায়তা আবেদন করে দুই বছরেও সহায়তা পায়নি।

প্রকৃত রোগী বঞ্চিত হলেও  ভূয়া রোগীর ফাইল তৈরি করে ঠিকই কোটি কোটি টাকা চেক বরাদ্দ করা হচ্ছে। এসব ভূয়া রোগীর ফাইল তৈরি করে দিতে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। দুই হাজার টাকা দিলে তাৎক্ষনিক রোগী বানিয়ে ফাইল তৈরি করে দিবে। বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। মন্ত্রীর ঘনিষ্টজন, মন্ত্রীপুত্র ও এপিএসের স্বজনরা এই সিন্ডিকেটের সদস্য। ৫০ হাজার টাকা রোগীর বরাদ্দ পেলে ফাইল অনুমোদনের চক্রটি অর্ধেক নিয়ে নেয়। মন্ত্রী, মন্ত্রীপুত্র ও মন্ত্রীর এপিএসের ঘনিষ্ঠজনরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই ভয়ে কেউ এতোদিন কোন প্রতিবাদ করেনি। 

কেউ কেউ নানা অনিয়ম দূর্নীতির প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে তার উপর নেমে আসে নির্যাতন। সে ছাত্রলীগ নেতা হউক বা আপন ভাই, ভাতিজা হউক। স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ভাষ্যমতে, নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি পরপর দুই বার এমপি নির্বাচিত হয়। প্রথমবার এমপি হয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পায়। দ্বিতীয়বার একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ সমাজকল্যাণমন্ত্রীর হয়। তাঁর নির্বাচনী এলাকা লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলা।  প্রতিবছর সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হ্নদরোগ(ক্রুটি) থ্যালাসেমিয়া এই  ছয়টি জটিল রোগের চিকিৎসা সহায়তায় আবেদন প্রার্থীদের বরাদ্দ দেয়। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে, বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ জেলা সমাজসেবা কার্যালয় নির্বাচিত প্রত্যেক রোগীকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে।

 ২৫ শতাংশ সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের জন্য সংরক্ষিত। জেলা সমাজ সেবা সিভিল সার্জনসহ তিন সদস্যের কমিটির মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের অধীনে সভা করে অনুমোদন নিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়। সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ বরাদ্দ রোগের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত আবেদনের অনুকূলে রোগীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংরক্ষিত বরাদ্দ থেকে ভুয়া রোগীদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে এই লুটপাট হচ্ছে। ভুয়া রোগী বানানোর কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় ১০ বছর ধরে। এই দুই উপজেলায় এখন ক্যানসার, কিডনিসহ জটিল ছয় রোগের ভুয়া রোগীর ছড়াছড়ি। প্রথম দিকে বিষয়টি তেমন নজরে আসেনি। হঠাৎ করে এই দুই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী বানিয়ে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

বিষয়টি গোয়েন্দা ও সংবাদ কর্মীদের অনেকের নজরে আসে। তথ্যমতে, কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর ১৬ ইউনিয়নে ৬টি মারাত্মক রোগীর ভুয়া সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কালগিঞ্জ ও আদিতমারীর ৫টি ইউনিয়নে ২৪৫ টি ভূয়াা রোগীর খোঁজ মিলেছে। এখন অনলাইনে ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে হয়। তাই বিষয়টি প্রকাশ্য চলে আসে। নুরুজ্জামান আহম্মেদ এমপি যখন প্রথম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান, তখন ব্যাংকিং কার্যক্রম ডিজিটালাইজ ছিল না। তখন এই সিন্ডিকেট মন্ত্রণালয়ে বসে ভূঁয়া রোগী বানিয়ে চেক ইন্স্যু করে ঐ ৫ বছরে প্রায় দেড়শত কোটি টাকা লোপাট করেছে। তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চিকিৎসা সহায়তা শাখা) কামাল হোসেন জানান, মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত যাচাই-বাছাই ও বাস্তবায়ন কমিটি রয়েছে। কমিটিতে সচিবালয় ক্লিনিকের সিভিল সার্জন বা তাঁর প্রতিনিধি চিকিৎসক সদস্য।  কমিটি অনুমোদিত তালিকা ধরে চিকিৎসা সহায়তার চেক বিতরণ করা হয়। ভুঁয়া রোগীর বিষয়টি আমার বিষয় নয়। কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিব ভূঁয়া যাচাই বাচাইয়ের দায়িত্ব। 

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ছয়টি রোগের রোগীদের ১৫০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ হয়। মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ (৩৭ কোটি ৫০ লাখ) বরাদ্দের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৯১ লাখ এবং ৬ হাজার ৭১৮ রোগীকে ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। লালমনিরহাট সমাজ সেবা দপ্তরের উপপরিচালক মোঃ আব্দুল মতিন জানান, জেলায় ৫টি উপজেলাসহ ৬টি ইউনিটে ত মাস অন্তর অন্তর প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ টাকা মন্ত্রাণালয়ের ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ হতে আসে। জুন টু জুলাই অর্থ বছরে ৪ কিস্তিতে অর্থ বরাদ্দ হয়। এ বছর দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার সময় দুই মাস অতিবাহিত হয়েছে বরাদ্দ পাইনি। 

জেলা পর্যায়ের বরাদ্দে শতভাগ নিয়ম মেনে করা হয়। সিভিল সার্জন সহ ৩ জন কমিটির সদস্য। তারপর জেলা প্রশাসক মিটিং করে বরাদ্দ চেক দেয়। এদিকে জেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর  ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্দরে পাথার ভাঙ্গার কাজ করতে গিয়ে পাথরের পাউডার ফুঁসফুঁসে প্রবেশ করে প্রাণঘাতি সিলিকোসিস রোগ হয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছে শতাধিক শ্রমিক। প্রায় ৬৫ জন শ্রমিক আক্রান্ত হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে। অথচ বুড়িমারীতে সমাজ সেবার চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র নেই ও শ্রমিকরা সহায়তা বঞ্চিত। আদিতমারী ও কালীগঞ্জে মন্ত্রীর ঘনিষ্টজনদের  অনিয়ম দূর্নীতির প্রতিবাদ করলে নেমে আসে নির্যাতন। 

এক ছাত্রলীগ নেতাকে কালীগঞ্জ থানায় ডেকে এনে নির্যাতনে ঐ নেতা সংবাদ সম্মেলন করেছে। আপন ছোটভাই কালীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মাহাবুব আহম্মেদ জামান মন্ত্রী পুত্রের রোষানলে পড়ে ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে তাকে (আপন চাচাকে) সভাপতি হতে অপসারণ করে মন্ত্রীপুত্র ভাতিজা নিজে সভাপতি হয়েছে। অথচ মন্ত্রীপুত্র সরকারি কলেজের প্রভাষক। তিনি কোন অবস্থাতেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে সভাপতি হতে পারেন না। এদিকে জন্মগত ক্রুটি মলদ্বার সংকচন নিয়ে শিশু মিমের জন্ম হয়। দুই বছর বয়স তার। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর দৈনিক জনকন্ঠে সহায়তা চেয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। আদিতমারী উপজেলা আওয়ামলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোঃ রফিকুল এর মাধ্যমে শিশুটির বাবা দরিদ্র হোটেল কর্মচারী লিমন হোসেন ও  মা নূর জাহান বেগম  সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছিল। মন্ত্রী অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল কিন্তু  দুই বছরে কোন সহায়তা দেয়নি। 

তবে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চিকিৎসক সহায়তা সাধারণ মানুষের কাছ হতে নিতে হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।  কালীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মোঃ মাহাবুব আহম্মে জামান জানান, অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত হওয়া খুব প্রয়োজন। যদি দূর্নীতি অনিয়ম হয়ে থাকে, যে দায়ী হউক তার দৃষ্টান্তমূলক মাস্তি হতে হবে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শোষনমুক্ত দেশ গঠনের ঘোষনা দিয়েছে। তিনি পারবেন এইসব অনিয়ম দূর্নীতি মুক্ত করতে। দেশের ১টি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা এসব অনিময় দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি তদন্ত করতে মাঠে নেমেছে। তারা ভুয়া রোগীর নামে বছরে ৩৭ কোটি টাকা তঠরুপের প্রমাণ পেয়েছে।
 
 

 

এমএস

×