ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করতোয়া এখন মৃতপ্রায়

-

প্রকাশিত: ০১:১২, ১ অক্টোবর ২০২২

করতোয়া এখন মৃতপ্রায়

পৌরাণিক ও ইতিহাসের প্রমত্তা করতোয়া আজ মৃতপ্রায়

পৌরাণিক ও ইতিহাসের প্রমত্তা করতোয়া আজ মৃতপ্রায়। করতোয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছে যে শহর বগুড়া, তা চেনা যায়। সেই করতোয়াকে আর চেনা যায় না। এই নদীর গল্প এখন বংশ পরম্পরায় প্রবীণদের কাছ থেকে শুনছে প্রজন্মরা। বাস্তবের গল্পকথার সেই নদীর তীরে গেলে প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা বিশ^াস করতে চায় না শোনা গল্প সত্য। মনে করে কল্পকথা। শহরের কিছু মানুষ নদীর দুই তীরে এবং ভিতরে বালি ফেলে করতোয়া দখল করে নিয়েছে।

প্রায় এক যুগ আগে বগুড়া জেলা প্রশাসন করতোয়া দখলদারদের চিহ্নিত করে তালিকা করে। তার ক’বছর পর জেলা প্রশাসন দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান চালায়। মাঝপথে অদৃশ্য কারণে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। দখলের যে স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হয় তা পুরনায় গড়ে ওঠে। আরেকদিকে প্রভাবশালী দখলদারের স্থাপনায় উচ্ছেদের সামান্য টোকাও পড়েনি।
বর্তমানের করতোয়া নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, নদী হয়েছে সরু খাল। নদীর ভিতর পৌরসভার বর্জ্য ফেলে পানি দূষিত করা হয়েছে। করতোয়া নদীর ওপর সেতু দেখে বোঝা যায় নিকট অতীতে নদীর প্রবাহ কতটা ছিল। সেই নদী আজ রুগ্ন শীর্ণকায়। প্রবীণরা তাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শুনেছেন, এই নদীর ওপর দিয়ে চলত মহাজনী বড় নৌকা। বড় বজরা নৌকা ভিড়ত তীরে। নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে।

পাল তোলা বড় বড় নৌকা দেখার জন্য লোকজন করতোয়ার তীরে ভিড়ত। মৌসুমে ঢেউয়ের তালে নৌকা বাইচ হতো। পৌরাণিক পটভূমি থেকে জানা যায় উপাখ্যানের লখিন্দরের নৌকা করতোয়া নদী দিয়ে যেত পাবনার বিনসাড়া গ্রামে। প্রাচীন ইতিহাস কথা বলে এভাবে: মহাস্থানগড়ের কয়েকটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই নদী। মুসলিম সাধক হযরত শাহ সুলতান বলখী (র) করতোয়া নদী দিয়ে মাছ আকৃতির বড় নৌকায় চড়ে ধর্ম প্রচারে  মহাস্থানগড় এসেছিলেন। করতোয়ার নাম ও উৎপত্তির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৮৭ সালে তিস্তার মহাপ্লাবনে করতোয়া আদি উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও ড. শেখ মেহেদী মোহাম্মদ লিখেছেন করতোয়ার বর্তমান উৎস ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার ভক্তিনগর থানাধীন বৈকুণ্ঠপুর অভয়ারণ্য থেকে একই জেলার রায়গঞ্জ থানার সুকানি পর্যন্ত। ভারতীয় অংশের করতোয়া উর্ধ প্রবাহের দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার। বাংলাদেশে করতোয়া পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলাধীন দেবনগর ইউনিয়নের শিবচন্ডি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার আলোকঝাড়ি পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশের উর্ধ প্রবাহ নামে পরিচিত। যার দৈর্ঘ্য ১১৭ কিলোমিটার।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর পূর্ব ভোটারপাড়া ত্রিমোহনা (যা দেওনাই-চাড়ালকাটা-যমুনেশ^রি ও ঘিরনাইয়ের মিলিত ¯্রােত) থেকে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার খানপুর পর্যন্ত করতোয়ার মধ্যপ্রবাহের মোট দৈর্ঘ্য ১২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ত্রিমোহনা থেকে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাধীন বালুভরা গ্রাম এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলাধীন ময়দানহাটা ইউনিয়নের দাড়িদহ মহাবালা থেকে শেরপুর উপজেলার খানপুর পর্যন্ত বগুড়া করতোয়া নামে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় অংশের করতোয়ার দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশে নদীটির দৈর্ঘ্য ৪৮১ কিলোমিটার অর্থাৎ করতোয়ার মোট দৈর্ঘ্য ৫৪৩ কিলোমিটার।
করতোয়া নামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন কোচ জনগোষ্ঠী তিস্তা ও করতোয়া উজানের অংশের অধিবাসী। এরা বসবাস শুরু করে নদী তীরের প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যে। কোচদের দেয়া নদীর নাম ‘করত’। পুরানের রচয়িতাগণ ‘করত’ শব্দকে সংস্কৃত ভাষায় রূপদান করে নামকরণ করেন করতোয়া। যার অর্থ হলো নিঃসৃত পানি।

করতোয়া নদীর নামের অর্থের এই নিঃসৃত পানি দূর অতীতে ছিল সাধারণ মানুষের পবিত্র পানি। এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক নগরী শহর বন্দর। নগরী আজ সম্প্রসারিত হয়ে আকাশচুম্বি অট্টালিকায়। ইতিহাসের করতোয়া পরিণত হয়েছে মরা খালে। সভ্য মানুষেরাই হত্যা করছে করতোয়াকে।
সমুদ্র হক, বগুড়া

×