ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর

কন্যাকে লেখা মুজিবের চিঠি... স্বাধীনতা পর্যন্ত ইতিহাস

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ৩ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ১০:২০, ৪ আগস্ট ২০২২

কন্যাকে লেখা মুজিবের চিঠি... স্বাধীনতা পর্যন্ত ইতিহাস

ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর

হাসু মনি, স্নেহ ও ভালবাসা নিওওয়াজেদের (ড. ওয়াজেদ মিয়া) চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবেজেল হতে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই...১৯৬৯ সালের ১৩ জুন পিতা মুজিব তার স্নেহের কন্যা শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিটি এভাবেই শুরু করেন

জাতির জনকের এমন একটি চিঠির প্রতিকৃতি আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরেচট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী পুষ্পিতা চৌধুরীসহ তার বন্ধুরা ক্লাস শেষে এসেছেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেখতেতিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যে আপদমস্তক একজন বিনয়ী মানুষ তা এই চিঠি পড়লে বোঝা যায়

মেয়েজামাই এবং মেয়ের প্রতি বাবাদের যে মমত্ববোধ ও ভালবাসা তা এই চিঠির পরতে পরতে রয়েছে১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা চিত্র এবং ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনীতে আনা হয়েছেবেশ ভাল লাগল

সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা, পারিবারিক, সামাজিক রাজনৈতিক এবং জাতির পিতার আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন তুলে ধরতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরযা প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে ১ আগস্টরেলের বগিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরটি যেন একেকটি ইতিহাসের অধ্যায়, যাতে ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতার সকল ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে

রেলের বগিতে গড়ে তোলা জাদুঘর ঘুরবে দেশের বিভিন্ন জেলায়একটি মিটারগেজ ও একটি ব্রডগেজ রেল কোচ একই ধরনের দুইটি জাদুঘরব্রডগেজটি পশ্চিমাঞ্চলে আর মিটারগেজটি পূর্বাঞ্চলে

নগরীর প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনেই মিটারগেজ রেলের বগিটি ঘিরে এখন বিশ^বিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল এবং সাধারণ মানুষের ভিড়কেননা ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর বিষয়টি যেমন ব্যতিক্রম তেমনি নতুনআর বঙ্গবন্ধুকে জানতে এমন উদ্যোগও উল্লেখযোগ্য

এমন প্রয়াসের কারণে মানুষ ভিডিও এবং অডিওর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর দিন জানতে পারছেআর রেলের বগিতে এমন আয়োজনে নিজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সবাই ছুটছে স্টেশনেআর অন্যান্য জেলার লোকেরা জেনে নিচ্ছে কখন আসবে রেল জাদুঘরটি

সিটি কলেজের শুধু পুষ্পিতার সহপাঠী এহতেশামুল আকতাব, প্রিয়া চৌধুরী, তন্ময় আচার্য্য এসেছে জাদুঘরেতারা জানালেন, স্বাধীনতার পর এতবছর বঙ্গবন্ধুকে অন্ধকারে রেখে ইতিহাস বিকৃত হয়েছেএখন মানুষ বঙ্গবন্ধুকে জানছেঘাতকের বুলেটে শাহাদাতবরণ করা বঙ্গবন্ধুকে যারা চেয়েছিল ইতিহাস থেকে মুছে দিতে, তারা সফল হয়নি

আমরা নতুন প্রজন্ম জানতে আগ্রহীবঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনলাইনে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরে এসে তথ্যবহুল ও মনোমুগ্ধকর চিত্র এবং বিভিন্ন ডিজিটাল কনটেন্ট দেখেছি৭ মার্চের ভাষণটা হেডফোনে শুনে উচ্ছ্বসিত প্রিয়া চৌধুরীতিনি জানান, এখানে দারুণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৭ মার্চের ভাষণ এবং কয়েকটি দেশে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন এসবও শুনলাম

রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো তিনটি বগি রয়েছেএরমধ্যে একটি বগি রঙিনসেটিই জাদুঘর, যার গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্তবগির দরজা খুলে ঢুকতে চোখে পড়ে ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের দুটো আলোকচিত্র আর মাঝে একটি এলইডি স্ক্রিনে ভেসে বেড়াচ্ছে তথ্যচিত্র, যা শোনাও যাবে হেডফোন দিয়ে

মোট ১০টি পৃথক ভাগ করা হয়েছেপ্রথমে রয়েছে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি এবং সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধুর বিয়ের ছবি আর তথ্যচিত্রে দেখানো হচ্ছে ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তথ্যচিত্রএরপর রয়েছে ১৯৪৩ থেকে ১৯৫২ সালের তথ্যভা-ার, যাতে বঙ্গবন্ধুর ১৯৪৬ সালের যখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন সেই ছবি, ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দুর্বার ছাত্র আন্দোলন এবং ১৯৪৯ সালের  রোজ গার্ডেনের ছবি

এরপর ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪, ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ভাষা আন্দোলন পরবর্তী, সংগ্রাম ও অবর্ণীয় নির্যাতন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস রয়েছে১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত আলোকচিত্র ও তথ্যচিত্রে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদানের চিত্রতবে ১৯৭৫ সালের তথ্যচিত্র দেখে হতবিহ্বল হতে হয় দর্শনার্থীদেরজাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম এক ঘটনা, উল্লেখ করে আগত শিক্ষার্থীরা

বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাতির এই সূর্যসন্তানের ইতিহাস জানার জন্য এর ব্যাপ্তি বাড়ানোর কথাও জানান দর্শনার্থীরাতারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে জানাতে এমন আয়োজনের ব্যাপ্তি ও পরিসর বাড়ানো যেতএকটি বগিতে আসলে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস তুলে ধরা যায় নাতবে স্বাধীনতার পর এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়

রেলের বগির দুপাশে তুলে ধরা এমন তথ্যচিত্রের পাশাপাশি রয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্রের প্রতিকৃতি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় ঐতিহাসিক স্থাপনার প্রতিকৃতিতবে বঙ্গবন্ধুর ছয়টি চিঠি পড়তে বেশ আগ্রহ দেখা গেছে নতুন প্রজন্মকেআর জাদুঘরে একটি বড় এইডি ডিসপ্লেতে চলছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা ঘটনা ও ঐতিহাসিক বিষয়াবলীর খণ্ডচিত্র

জয় বাংলা বুক শেলফ ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রয়েছে একটি বুক শেলফ, যা জয় বাংলা স্লোগানটি আদলে তৈরি করাপ্রায় ১শটি বইসমৃদ্ধ শেলফটিতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনক আমার নেতা আমার’, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীএবং আবদুল গাফফার চৌধুরী ইতিহাসের রক্ত পলাশসহ বিভিন্ন লেখকের বইএছাড়া জাতির পিতাকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন শিশুতোষ বইও রয়েছে জয় বাংলা শেলফে

কৃত্রিম বাগান জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যশৈলীতে বাস্তবিক একটি জাদুঘরের কক্ষের মতোতবে সেখানে রয়েছে একটি কৃত্রিম বাগানপ্লাস্টিকের ফুল দিয়ে করা বাগানটি দেখতেই বাস্তবে বাগানের মতো লাগে

এদিকে সার্বিক বিষয়ে জানতে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নিতবে রেলসূত্রে জানা গেছে বিস্তারিত

চট্টগ্রাম মহানগরীর রেলওয়ে স্টেশনে ১ আগস্ট উদ্বোধন হওয়ায় এই জাদুঘরটি থাকবে ৫ আগস্ট পর্যন্তসকাল ১০ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকবে জাদুঘর

যেসব স্টেশনে যাবে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি স্টেশনেই যাবে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর৫ আগস্ট নগরীর স্টেশন ত্যাগ করে তা ৬ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট সীতাকু-ে থাকবেএরপর ধারাবাহিকভাবে চিনকি আস্তানা স্টেশন, ফেনী, গুণবতী, নাঙ্গলকোর্ট, লাকসাম, চৌমুহনী, মাইজদীকোর্ট, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নরসিংদী, টঙ্গী এবং ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ১৮ নবেম্বর গিয়ে শেষ হবে প্রদর্শনীঅন্যদিকে আরেকটি কোচ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের গোপালগঞ্জ স্টেশনে থাকবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এরপর বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে যা চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে গিয়ে ৩০ নবেম্বর সমাপ্ত হবে

×