
সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ দলিত জনগোষ্ঠীর বেদে সম্প্রদায় এখন প্রবেশ করেছে বগুড়া নগরীতে। কখনও এদের চেনা যায়। কখনও চেনা যায় না। প্রত্যেক নারী বেদের কাছে থাকে কাঠের ছোট্ট বাক্স। মনে হবে কোন কিছু নিয়ে যাচ্ছে। এরা এই বাক্সের ব্যবহার করে ঠিক সময় বুঝে। তারপর!
একটি বর্ণনা ডিউক নামের এক ব্যক্তি শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়ক ধরে হাঁটছিলেন। স্মার্ট এই ব্যক্তিকে দেখে দুজন বেদে অর্থ সহযোগিতা চায়। অপারগতা প্রকাশ করলে বাক্সের ব্যবহার করে। ভিতর থেকে সাপ বের করে তার (ডিউক) সামনে ধরলে ভয়ে কাঠের বাক্সের ওপর ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় পরে কাঁপতে থাকে। পথচারীরা ধরাধরি করার সময় দুই নারী বেদে দ্রুত সটকে পড়ে। নারী বেদেরা এভাবে সাপের ভয় দেখিয়ে রোজগার করে। নগরীর যারা বেদেদের চেনে তার কিছু টাকা দেয়। তবে এই বেদেরা সাপের খেলা দেখায় না। বাক্সের সাপ তাদের রোজগারের বাহানা।
বগুড়া নগরীর উপকণ্ঠে বনানী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় বেদে হরিজন হিজড়াসহ দলিত জনগোষ্ঠী কেউ চাটাইয়ে মোটা রেক্সিন ও পলিথিন মুড়ে ঝুপড়ি ঘরের বস্তি বানিয়ে আবাস গড়ে তুলেছে। বেদেপল্লীর নারী বেদেরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। ছেলে বেদেরা পল্লীর ভিতরে আড্ডা দেয় তাস খেলে। এর মধ্যেই হরিজন ও বেদের উন্নত বস্তিও আছে। যেখানে সোলার প্যানেলে বিদ্যুত আছে। যাদের রোজগার বেশি তাদের ঘরে টিভিও আছে। সেল ফোন তো এখন সকলের কাছে তা বেদেই হোক হরিজন হোক আর হিজড়া হোক।
শহরের নারী বেদেদের বয়স বেশি নয়। কেউ বিবাহিতা। শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। আঙুলের চুটকি বাজিয়ে গান গায়। কেউ খালি গলায় জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুর তুলে। সঙ্গীরা নাচে। লোকজন বলে এরা মডার্ন বেদে। প্রবীণ ব্যক্তি সুলতানুল আলম বললেন, অতীতে নদীর ধারে কোন গ্রামে বেদের বহর নোঙর করত। আবাস ছিল বড় ছইয়ের বড় নৌকা। রান্না থাকা ঘুমানো সবই বেদের নৌকার মধ্যে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিকড় বাকড় বেচত। কারো দাঁতে ব্যথা হলে কথিত পোকা তুলে দিত। কেউ সাপের খেলাও দেখাত। অতীতের এই বেদে সম্প্রদায় লুকিয়ে আছে কোন হাওড়-বাঁওড়ে। তাদের উত্তরসূরী বেদেরা এখন বস্তি বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে ও নগরে।
বেদের মতো হিজরা সম্প্রদায়ও শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘরে তালি বাজিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে কথা বলে অর্থ রোজগার করে। বেদেরা তাও অবিষধর (না বিষধর) সাপ বাক্সে ভরে কৌশল করে। হিজরারা দল বেঁধে বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে (কখনও কোন বেসরকারী অফিসে) এমনভাবে চড়াও হয় মান সম্মান যাওয়ার ভয়ে যে যা পারে টাকা দিয়ে বিদায় করে। তাদের দাবি বড় অঙ্কের। এরাও এখন নগরীর বাসিন্দা তবে বস্তি ও ঝুপড়ি ঘরের।
অনগ্রসর এই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও মানবসম্পদে পরিণত করতে সরকারীভাবে বহুমুখী কর্মসূচী নিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে উপবৃত্তি প্রদান। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়িয়ে আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান। বগুড়া সমাজসেবা অধিদফতর জানায়, দেশে এই প্রথমবারের মতো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আবাসনের মাধ্যমেও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
হিজড়া, বেদে রবিদাসী (মুচি) বেহারাসহ দলিত সম্প্রদারের মধ্যে দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শুরু হয়েছে। কোভিডকালে এই প্রশিক্ষণ বন্ধ আছে। অবস্থা স্বাভাবিক হলে ফের শুরু হবে। ৫০ দিনের এই প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিজনকে দশ হাজার টাকার উপকরণ সহায়তা দেয়া হয়। প্রতিদিন তারা ৩শ’ টাকা করে ভাতা পান। উল্লেখ্য, ২০১২-১৩ অর্থবছর হতে বগুড়ায় প্রতি বছর এ ধরনের প্রশিক্ষণে এ পর্যন্ত ৫শ’ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের মূল ¯্রােতে ফিরিয়ে এনে কর্মজীবী করে তোলা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক জানালেন, কম্বল বুনন ও পাটজাত দ্রব্যের শপিং ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বর্তমানে কম্বল ও শপিং ব্যাগের চাহিদা বেশি থাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দ্রুত উৎপাদনে গিয়ে পণ্য বাজারজাত করতে পারে।
সূত্র জানায় দলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান ছাড়াও ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও তাদের আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে ৫০ বছরের অধিক বয়সী অক্ষম/দুস্থ দলিত সম্পদায়কে বিশেষ বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদফতরের সূত্রের জরিপে দেখা গেছে দেশে ৪৩ লাখ ৫৮ হাজার দলিত জনগোষ্ঠী আছে। হরিজন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৮৫ লাখ এবং বেদে জনগোষ্ঠী ৭ দশমিক ৮০ লাখ। বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে মাল বেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারি, বরিয়ালসান্দা, গাইন বেদে, ইত্যাদি।