
ছবি : সংগৃহীত
এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি মানেই ছিল, দিল্লির ইচ্ছা দক্ষিণ এশিয়ার পথনির্দেশ। কিন্তু সময় বদলেছে। আজকের বাংলাদেশ মাথা নিচু করে চলে না। বরং নিজস্ব কূটনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং ভৌগোলিক গুরুত্বের জোরে বিশ্বমঞ্চে এক সাহসী ও স্বাধীন সত্তা হয়ে উঠেছে। আর এই আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি যেন হয়ে উঠেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি বেইজিংয়ের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ড. ইউনূস সরাসরি বলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য সাগরগামী করিডোরে একমাত্র অভিভাবক এখন ঢাকা।” এই বক্তব্যের রেশ পড়েছে দিল্লির নীতিনির্ধারকদের টেবিলে। ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, সার্বভৌম অধিকারের নতুন ব্যাখ্যা, সব মিলিয়ে বাংলাদেশ তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে এক কৌশলী বার্তা।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে ভারত এখন নির্ভর করছে মিয়ানমারকে ঘিরে নির্মিত ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের উপর। সমুদ্র পেরিয়ে, কালাদান নদী ঘুরে, রাখাইন প্রদেশের বিদ্রোহ কবলিত অঞ্চল ভেদ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ, এই কঠিন করিডোরে ভারতের বাজেট দাঁড়িয়েছে ২২,৮৬৪ কোটি রুপি।
কিন্তু অর্থ শুধু প্রকল্পেই নয়, বাড়ছে প্রতিদিনের পরিবহন ব্যয়ও। বাংলাদেশের করিডোর ব্যবহার করলে এক টন পণ্য কলকাতা থেকে আইজল বা ইম্ফল পৌঁছাতে সময় লাগে চার-পাঁচ দিন, খরচ হয় প্রায় ৫০০০ রুপি। কিন্তু বিকল্প পথে সেই সময় বেড়ে দাঁড়ায় সাত-আট দিন এবং খরচ উঠে যায় ৯০০০ রুপির ওপরে। ফলে প্রতি টনে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০০০ রুপি। বছরে ১০ লাখ টন পণ্য পরিবহনের হিসেবে এ খরচ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি রুপি বা ৫৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ এতদিন ভারতের প্রতি ভূখণ্ড ব্যবহারে উদার ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে ঢাকাই পণ্য প্রবেশ করেছে করিডোর ব্যবহার করেই। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লির কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যুতে মনোভাব, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন ডেকে এনেছে।
এই পরিবর্তন ভারতের জন্য শুধু অর্থনৈতিক বোঝা নয়, কূটনৈতিক সংকেতও বটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দিল্লির বিকল্প করিডোর কৌশল শুধু বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা নয়, বরং চীনকে ঠেকানোর কৌশলও বটে। চীন ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তে সক্রিয়ভাবে অবকাঠামো গড়ে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের নতুন করিডোর লজিস্টিক সুবিধা, সেনা সরবরাহ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর একটা প্রচেষ্টা।
আজকের বাংলাদেশ জানে, তার কী শক্তি, কী গুরুত্ব। ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন আর পাশের দেশ নয়, বরং একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। দিল্লিও তা বুঝতে শুরু করেছে। ড. ইউনূসের স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত কূটনৈতিক অবস্থান শুধু শব্দ নয়, তা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশল বদলের সাঙ্ঘাতিক সূচনা।
আঁখি