
ছবি: জনকন্ঠ, কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর এলাকার মানুষের পানির একমাত্র পানির উৎস ছিল একটি মাত্র কুয়া।
কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শাহমীরপুর গ্রাম। কর্নফুলী নদীর দক্ষিণ তীর ঘেষে অবস্থিত পাহাড় বেষ্টিত সবুজ অরণ্যের মাঝে গ্রামটি। শান্ত স্নিগ্ধ ও মনোমুগ্ধকর এই পরিবেশটি যেন অজান্তেই মনের মধ্যে একটু খানি প্রশান্তির ছোঁয়া দেয়। পাখির কলকাকলিতে ঘেরা, সবুজের সমারোহ। এখন গ্রামটিতে এসেছে আধুনিকতার ছোয়া, এ আধুনিকতার ছোঁয়ায় যেন ভুলতে বসেছে প্রাচীন সব ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। পাহাড়ের বুক চিরে কোরিয়ান ইপিজেডের তৈরি সুবিশাল সড়ক পেরিয়ে শাহমীরপুর গ্রামে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ব্রিটিশ আমলে পানির তৈরি পানির কুয়া। এক সময়ে এই পাড়ায় ছিল না কোনো নলকূপ। গ্রামের লোকজন দৈনন্দিন কাজ ও খাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন কুয়ার পানি। এখন আর সেদিন নেই, এই এলাকার মানুষদের এক সময়ের পানির ভরসা একটি কুয়া এখন পরিত্যক্ত।
মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান শাসনেরও অবসান হয়েছে। ভগ্নাবশেষ নিয়ে দেয়াঙ পাহাড়ের ওপর ধুঁকছে দেয়াঙ কিল্লা। তার পাদদেশের মানুষগুলোও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসে ভুলতে বসেছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তবু নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার শেষ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
বর্তমানে কুয়া থেকে পানি তোলার কথা এখন ভাবতেই পারে না মানুষ। কিন্তু একসময় কুয়ার পানিতেই মিটেছে তৃষ্ণা, সারতে হয়েছে গৃহস্থালি কাজ। গ্রীষ্মের খরতাপে পুকুর-খাল-বিল যখন শুকিয়ে যেত, তখন কুয়া হয়ে উঠত পানির একমাত্র উৎস। এটি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বড়উঠান এলাকার শাহমীর মাজারের পশ্চিমে আসকর মিয়াজি মসজিদের পাশে ফিরিঙ্গি পাড়াসংলগ্ন এলাকায় এটি অবস্থিত। বহুদিন আগে ভেঙে পড়েছিল কুয়াটি। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসন নতুনভাবে সংস্কার করে। যেখানে মূল কুয়ার বেশকিছু পুরোনো ইট এখনও রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ব্রিটিশ আমলের তৈরি এটি। সুপেয় পানি জন্য গ্রামের মানুষ কুয়ার পানি ব্যবহার করতো। ৩০ বছর আগে থেকে কুয়ার পানি উঠা বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদের মুসল্লীরা ওযুর কাজে ব্যবহারসহ হিন্দু ধর্মালম্বী নারীরা কলসী ভরে নিয়ে যেতেন পানি। এখন অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। এসব স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া খুবই প্রয়োজন বলে দাবী করেন স্থানীয়রা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ কর্ণফুলীর বড়উঠানের দেয়াঙ। এখানকার গৌরবগাথা গল্প এখনও লোকমুখে ফেরে। ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে এসে দেয়াঙয়ে বসতি গড়েন ১৫৩৭ সালে। ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বর্তমান আনোয়ারা-কর্ণফুলী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। ধারণা, আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল দেয়াঙ। সে সময়কালে পর্তুগিজরা এ পানির জন্য কুয়াটি নির্মাণ করেছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুল হালিম বলেন, পানির সব উৎস এখন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এর পানিতে কাপড় ধোয়া, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালি সব কাজ করা হতো। সুপেয় পানি পান করার জন্য এই কুয়া তৈরি করা হয়েছিল। সংস্কারের অভাবে প্রচীন আমলের ঐতিহ্যের কুয়াগুলো এখন বিলুপ্তির পথে।
৫৫ বছরের স্থানীয় বৃদ্ধ আবদুল হক বলেন, গত ৩০ বছর আগেও গ্রামের মা-বোনের কলসি কাঁখে এই কুয়া থেকে পানি নিয়ে যেতে দেখেছি। সারাক্ষণ এখানে পানি থাকতো, কৃষকরাও কৃষি জমিতে পানি ব্যবহার করছে। প্রায় ৯০ থেকে ১ শ বছর পূর্বে গ্রামে সুপেয় পানি পান করার জন্য এই কুয়া তৈরি করা হয়েছিল বলে আমরা মুরব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি। সংস্কারের অভাবে ব্রিটিশ আমলের কুয়া এখন বিলুপ্তির পথে। এছাড়াও গ্রামের পাশে কাফকো, কেইপিজেড, সিইউএফএলসহ বিভিন্ন কারখানায় গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তুলে ফেলার কারণে দেখা দিয়েছে এখন পানি সংকট। যার ফলে কুয়ার পানির দৃশ্য আর দেখা যায় না। এটি সংরক্ষণের দাবীও জানান তিনি।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে এটি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুমু