ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কম জিআইযুক্ত ব্রি-১০৫ ধান উদ্ভাবন

ডায়াবেটিস রোগীরা পেট ভরে খেতে পারবেন

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৮ মে ২০২৫

ডায়াবেটিস রোগীরা পেট ভরে খেতে পারবেন

নীলফামারীর খুটামারা গ্রামে চলছে ধান কাটা ও মাড়াই

ধান থেকে চাল। তারপর ভাত। কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। পান্তা ভাতের প্রচলন কমে যাওয়ায় এখন গ্রামের মানুষজন সকাল-দুপুর ও রাতে  তিন বেলায় ভাত খেয়ে থাকেন। দেহে আবার রোগবালাইয়ের কমতি নেই। সে ক্ষেত্রে ভাতেরও রকম ফের বের হয়েছে। পুষ্টিগুণে ভরপুর এমন ভাতেরও প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস ও স্থূলতা এবং  কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত তাদের জন্য ভাত হিসাবের খাতায় ওঠেছে। চিকিৎসকগণ এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, বলা হয় ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণত রক্তের গ্লুকোজ কমাতে ভাতের বদলে রুটি খেতে হবে। এছাড়া স্থূলতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগীদের ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ দেওয়া হয়। আবার এ বিষয়টি মেনে চলা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের জন্য দারুণ একটি সমাধান বের করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই)। যা  কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের (জিআই) ধান। বলা হচ্ছে বোরো ধানের পুরনো জনপ্রিয় জাতগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে প্রাকৃতিকভাবেই এখন প্রত্যাশিত ফলন দিতে পারছে না। ১৯৯৪ সালে বাংলাদশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত ব্রি ধান-২৮ এবং ব্রি ধান-২৯ প্রায় আড়াই যুগ ধরে বোরো উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে।

আবার দেশে ধান উৎপাদনে বোরো মৌসুম সর্বাধিক উৎপাদনশীল। তাই দেশে সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তায় ব্রি ধান-২৮ এবং ব্রি ধান-২৯ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় আবাদকৃত জাত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে জাত দুটির বয়স বাড়ার সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে আসছে। পুরনো জাতের বিদায় এবং নতুন জাতের শুরুকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কৃষিবিদগণ। এজন্য কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এ তথ্য। বোরো মৌসুমে কম জিআই সমৃদ্ধ ও উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ১০৫ গত তিন বছর থেকে বোরো মৌসুমে এ ধান উৎপাদন করছেন কৃষকরা। ধীরে ধীরে এর চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সারাদেশেই চলতি মৌসুমে এ ধান চাষ হয়েছে। সূত্র মতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪২২ মিলিয়ন মানুষের ডায়াবেটিস আছে। তাদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর ১.৫ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য সরাসরি ডায়াবেটিস দায়ী। ক্রমবর্ধমান এসব স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বিশ্বজুড়ে কম জিআইযুক্ত চালের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কোন খাবারগুলো ভালো তা খুঁজে বের করা সংক্রান্ত গবেষণায় ১৯৮০ সালে ড. ডেভিড জে জেনকিন্স এবং তার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা গ্লাইসেমিক সূচক তৈরি করেন। জিআই ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কেলে খাবারের র‌্যাঙ্ক তৈরি করে। স্কোরগুলো রক্তের চিনির মাত্রায় খাবারের প্রভাব নির্দেশ করে। গ্লাইসেমিক সূচক কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারকে ৩টি সাধারণ ভাগে বিভক্ত করে। এগুলো হচ্ছে-উচ্চ (৭০ ও তার বেশি), মাঝারি (৫৬ থেকে ৬৯) এবং নিম্ন (৫৫ ও এর নিচে)। ব্রি ধান ১০৫-এর জিআই স্কোর ৫৫। বর্তমানে ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়। প্রায় ৪০ শতাংশ জমিতে এগুলো চাষ করা হয়। ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯-এর জিআই স্কোর যথাক্রমে ৭০ দশমিক ৯৬ ও ৬২ দশমিক ৩৬। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধাসহ ৫ জেলায় এবার বোরো মৌসুমে ধান আবাদ হয় ৫ লাখ ৯ হাজার  ৫৬ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টরেই উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ১০৫ চাষ হয়েছে। বর্তমানে  এ ধান কেটে কৃষকরা ঘরে তুলছেন। হেক্টরপ্রতি  ধান উৎপাদন হয়েছে ৭ মেট্রিক টন। কৃষিবিদরা বলছেন এটি সর্বোচ্চ হেক্টর প্রতি ৮ মেট্রিক পর্যন্ত ফলন হবে। এ ধান উৎপাদনে কৃষি বিভাগের পক্ষে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার খুটামারা ইউনিয়নের পূর্ব খুটামারা মাঝাপাড়া গ্রামের কৃষক সাইদার রহমান। তিনি জানালেন আমাদের পরিবারে ডায়াবেটিস রোগী যেমন আছে তেমনি স্থূলতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগীও আছে। এ ধানের চালের ভাতের গুণের কথা জানতাম না। কৃষি বিভাগের পক্ষে গত তিন বছর ধরে কৃষকদের এ ধান চাষের জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি মাথায় নিয়ে এবার প্রথম এ ধান চাষ করছি পরীক্ষামূলকভাবে। সফলতাও পেয়েছি। “আমি এবার  ১ বিঘা জমিতে ব্রি ধান-১০৫ চাষ করি। ফলন ভালো হয়েছে। ধানটা দেখতে একটু চিকন। কাটাই মাড়াই করে ভাতও খাচ্ছি। খেতেও সুস্বাদু। সবচেয়ে ভালো দিক হলো আমার পরিবারে  ডায়াবেটিস ও স্থূলতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগীরা রুটি ছেড়ে এ চালের ভাত দুই বেলা খাচ্ছেন। এতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরং শরীরও হাল্কা হয়ে গেছে। তিনি বললেন আগামী মৌসুমে এ ধানের আবাদ বাড়িয়ে ৫ বিঘায় নিয়ে যাবো। কারণ রোগ বালাইয়ে এ ধানের ভাত দারুণ সমাধানের নিরাপদ পথ প্রর্দশক। বাজারেও চাহিদা আছে বলে মনে হচ্ছে। আরেক কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, “আগে আমরা শুধু ফলনের দিকে তাকাতাম। এখন বুঝতে পারছি, পুষ্টিগুণ ও গুরুত্বপূর্ণ। ব্রি-১০৫ আমাদের নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।” আমি এবার ৩ বিঘা জমিতে এ ধান চাষ করেছি। ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জিয়াউল হক বলেন, “ব্রি ধান-১০৫ একটি উদ্ভাবনী জাত। আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি এ ধান চাষে আগ্রহী হতে। এটি আবাদে সহজ, রোগবালাই সহনশীল এবং ফলনও যথেষ্ট ভালো। পাশাপাশি এর পুষ্টিগুণও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও জানান, “আমরা মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি যাতে কৃষকরা লাভজনকভাবে এ ধান চাষ করতে পারেন।” জলঢাকা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমন আহমেদ জানান, “ব্রি ধান-১০৫ বিশেষ করে  ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি বড় সুযোগ।

আমরা এ বছর নতুন করে পাঁচটি ইউনিয়নের কৃষকদের মাঝে এ জাতের ধান ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে উপজেলায় এ বছর গড় লক্ষ্যমাত্রা ৭.০৫ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি আমাদের স্বাস্থ্য ও কৃষি উভয় খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। ভবিষ্যতে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণেও সহায়তা করা হবে।” তিনি আরও বলেন, “উন্নত জাতের ধান চাষে কৃষককে সবধরনের কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী মৌসুমে এ ধানের চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।” তিনি এ বিষয়ে আরও জানালেন এ জাতটি তৈরি করতে ২০০৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ডায়াবেটিস রোগীর কথা চিন্তা করে ব্রি-র বিজ্ঞানীরা জাতটি উদ্ভাবন করেছেন। তাই  ডায়াবেটিস রোগীরা এ ধানের চালের ভাত নিরাপদ মনে করে খেতে পারবেন। লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন এ ধানের চালের ভাত খেলে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করা কমে যাবে। ব্রির প্রধান কার্যালয়ে পুষ্টি গবেষণা বিভাগের পরীক্ষায় ব্রি ধান ১০৫-এর পুষ্টিমান নির্ণয় করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তিনি বলেন, ব্রি-ধান ১০৫ একটি উচ্চ ফলনশীল স্বল্প গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন সারাদেশের চাষাবাদ উপযোগী বোরো মৌসুমের একটি জাত। জাতটির কৌলিক সারি বিআরসি ২৬৬-৫-১-১-১। উক্ত কৌলিক সারিটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয়, কুমিল্লায় বিআর ১৬-এর সাথে ৯০০৬০-টিআর ১২৫২-৮-২-১-এর ২০০৬ সালে সংকরায়ণ করে বংশানুক্রম সিলেকশন (Pedigree Selection) এর মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়। ব্রি কুমিল্লার গবেষণা মাঠে হোমোজাইগাস কৌলিক সারিটি নির্বাচন করা হয় এবং পরবর্তীতে ব্রি কুমিল্লা হতে ব্রি গাজীপুরে নির্বাচিত  হোমোজাইগাস কৌলিক সারিটি স্থানান্তর করে ৫ বছর ফলন পরীক্ষার পর ২০১৭ সালে ব্রি’র আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহের গবেষণা মাঠে ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অতঃপর ২০২০ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী কর্তৃক স্থাপিত প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষার (পিভিটি) পর ফলাফল বিশ্লেষণ করে জাতীয় বীজ বোর্ডের কারিগরী কমিটির সভায় পুনঃমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর ২০২১ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক স্থাপিত পিভিটি পরীক্ষায় সন্তোষজনক হওয়ায় ২ মার্চ ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় এ জাতটি লো জিআই সমৃদ্ধ বোরো মওসুমের উচ্চ ফলনশীল জাত হিসাবে দেশজুড়ে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। কৃষিবিদরা জানালেন ডায়াবেটিস ছাড়াও স্থূলতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগে ভুগছেন এমন শ্রমজীবী ??ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্যও উপকারী এ চাল। এ জাতের দানার আকার ও আকৃতি মাঝারি সরু ও রঙ সোনালী। এর জীবনকাল ১৪৮ দিন। এ জাতের ১০০০টি দানার ওজন ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম। এতে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৭ শতাংশ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। রান্না করা ভাত ঝরঝরে এবং সুস্বাদু। তাই এ ধানের আবাদ করে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। ‘প্রতি কেজি ধানের গড় উৎপাদন খরচ ২৭ টাকা ১০ পয়সা। একই টাকা খরচ করে কৃষকরা ব্রি ধান ১০৫ চাষ করতে পারবেন।’ বিআরআরআই উদ্ভাবিত এ চাল আঠালো নয় এবং এর গুণমান আরেকটি জিআই ভেরিয়েন্ট বিআর ১৬ থেকে ভাল। ব্রি ধান ১০৫ উৎপাদনশীলতা এবং জীবনচক্রের দিক থেকেও বিআর ১৬ কে ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে বালাম ধানের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৬ টন, সেখানে ব্রি ধান ১০৫-এর উৎপাদন ৭ দশমিক ৬ টন। এছাড়া, বালাম ধান উৎপাদনে ১৫৫ থেকে ১৬০ দিন লাগলেও ব্রি ধান ১০৫ উৎপাদনে সময় লাগে ১৪৮ দিন।

প্যানেল

×