
ছবি: সংগৃহীত
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই পুরানো দিল্লির ছাদে ছাদে শুরু হয় এক অসাধারণ দৃশ্য। শত শত কবুতরের ঝাঁক আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়, আর ছাদ থেকে ভেসে আসে বাঁশির শব্দ, সিটি এবং নাম ধরে ডাকা। এই ঐতিহ্যবাহী কবুতর পালন বা "কাবুতরবাজি" শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই পুরুষ-প্রধান জগতে এক ব্যতিক্রমী নাম—শাহীন পারভীন, দিল্লির একমাত্র নারী কবুতরবাজ।
কাবুতরবাজির ইতিহাস বহু প্রাচীন। ইতিহাসবিদ রানা সাফভি জানান, কবুতর পালনের রীতি মহাভারতের সময়েও ছিল, তবে মুঘল আমলে এটি এক শিল্প ও প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজেই কাবুতরবাজিকে প্রেমের সাথে তুলনা করতেন। এই ঐতিহ্য আজও পুরানো দিল্লির অলিগলিতে বেঁচে আছে।
এই ঐতিহ্যে নারীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। শাহীন পারভীন সেই নিয়ম ভেঙেছেন। খাজা মীর দরদ বসতির বাসিন্দা পারভীন একজন উঁচুমানের কবুতরবাজ। দিনে গৃহস্থালির কাজ সামলান, আর সন্ধ্যায় ছাদে উঠে নিজের শতাধিক কবুতরের খোঁজখবর নেন।
তিনি বলেন, "আমি প্রতিদিন সকালে সবার আগে কবুতরগুলোর স্বাস্থ্য দেখি, খাওয়াই, তাদের প্রশিক্ষণ দেই। বিকেলে উড়ানোর সময় ডাকে ফেরানোর চর্চা করি। এরা আমার সন্তানের মতো।"
ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ছাদে কবুতর দেখতে দেখতে এই ভালোবাসার শুরু। কিন্তু কিশোরী বয়সে ভাই বাধা দেন, সমাজও ব্যঙ্গ করে—"মেয়েদের এসব মানায় না।" তবু হাল ছাড়েননি শহীন। দিনের পর দিন নিজে শিখেছেন, ভুল থেকে শিখেছেন, কবুতরের ভাষা বুঝতে শিখেছেন।
তিনি বলেন,"শুরুতে অনেকে হাসতো। বলতো মেয়ে হয়ে কবুতর পালা! কিন্তু যখন আমার কবুতররা প্রতিযোগিতায় জেতে, সবাই চুপ হয়ে যায়।"
পুরানো দিল্লির একটি বড় কবুতর প্রতিযোগিতায় শাহীনের কবুতরের দল জয়ী হয়। দূরবর্তী এলাকা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় কবুতর, যারা উড়ে ফিরে আসে নিজ ছাদে। এই প্রতিযোগিতা ছিল দক্ষতা, স্মৃতি ও উস্তাদের ডাক চিনে ফেরার ওপর নির্ভরশীল। শতাধিক অভিজ্ঞ পুরুষ উস্তাদের মাঝে শাহীনের জয় ছিল এক দৃষ্টান্ত।
তিনি বলেন, "সেদিন আমার ছাদে অনেক মানুষ এল। কেউ টাকা দিল, কেউ মালা পরাল। কেউ বলল, মনে হচ্ছে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছে। আমি আনন্দে কাঁদছিলাম।"
শাহীন বলেন, "অনেকেই চায় আমি তাদের কবুতর দেখে দেই, কিন্তু আমার নিজের কবুতরের জন্যই সময় পাই না। আর খরচও অনেক—খাবার, ওষুধ সব কিছুতে হাজার হাজার টাকা লাগে। "
এখন কাবুতরবাজি পুরানো দিল্লির পর্যটকদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হেরিটেজ ওয়াকের অংশ হিসেবে মানুষ শাহীনের ছাদে আসেন, তার কবুতরের খেলা দেখেন, ভিডিও করেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বহুবার।
ফটোগ্রাফার ইমরান বলেন, "আমি ইউটিউবে অনেক দেখেছি কবুতরবাজি, কিন্তু এখানে এসে নিজে দেখে শিহরিত হয়েছি। শাহীনের মত নারীর গল্প সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে।"
শাহীন বলেন, "যদি কবুতরের সঙ্গে সময় না কাটাই, মন খারাপ হয়ে যায়। ওরা আমার মনের কথা বোঝে। আমি যেমন ওদের ডাক দেই, ওরাও আমাকে চেনে। ওরা জানে আমি কেমন আছি। এটা এক আত্মিক সম্পর্ক, যেটা আপনি রাতারাতি তৈরি করতে পারবেন না।"
মুমু