ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

এক ডিমে দুই কুসুমের হাঁসের খামার

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

এক ডিমে দুই কুসুমের হাঁসের খামার

মুরগির ডিমে মাঝে মাঝে ভাগ্যক্রমে পাওয়া যেত এক ডিমে দুই কুসুম। কিন্তু এবার হাঁসের ডিমেও মিলছে দুই কুসুম। চিকিৎসকদের মতে ডিমের কুসুম হাড় দীর্ঘায়ু ও মস্তিষ্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করে। মুরগি বা হাঁসের ডিমসহ -সব ডিমই এখন মানবদেহের জন্য উপকারী। পানিশালা গ্রাম। গ্রামটি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নে। এই গ্রামের খামারি আলফ্রেড টিটো। তার খামার হতে হাঁসের ডিম নিলেই এক ডিমে দুই কুসুম মিলবে। তার খামারে রয়েছে বিশেষ জাতের তিনশ’ হাঁস। ‘পুষ্টি সংক্রান্ত নানা গবেষণায় অনেক সময়ই কিছু না কিছু ফাঁক থেকে যায়, কিন্তু চীনের একটি বড় সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে চালানো গবেষণা থেকে অন্তত একটা বিষয় পরিষ্কার যে প্রতিদিন একটা ডিম খেলে তার থেকে হৃদযন্ত্র বা শরীরের রক্ত সঞ্চালনে কোন ঝুঁকি তৈরি হয় না, বরং প্রতিদিন একটা ডিম স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে’ - বলছেন ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিটা ফরুহি। আজকাল অধিকাংশ স্বাস্থ্যসচেতন মানুষই ডিমের সাদা অংশ খেলেও ডিমের হলুদ অংশ অর্থাৎ কুসুম ফেলে দেয়। কিন্তু ডিমের কুসুমও শরীরের পক্ষে কতটা উপকারী তা অনেকেই জানেন না। কুসুম হ্রদরোগে ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়। রংপুর কারমাইকেল কলেজ হতে ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন টিটো। সরকারী বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজ উদ্যোগে মাঠে নেমেছে পড়ে টিটো। টিটো বলেন, পৈতৃক একটি বড় পুকুর রয়েছে তার। প্রথমে ওই পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। গত ছয় মাসে প্রায় এক লাখ টাকার মাছও বিক্রি করেছেন। কিন্তু তার লক্ষ্য বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা আয় করা। এজন্য পুকুরের উপরে গড়ে তুলেছেন একটি হাঁসের খামার। পাশাপাশি গরুর খামারও করেছেন তিনি। ওই খামারে ১৫টি উন্নতজাতের গরু রয়েছে। চারমাস আগে নাটোরের উত্তরবঙ্গ হাঁস প্রজননকেন্দ্র থেকে ৩০০টি একদিন বয়সী হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করেন টিটো। এরপর নিজেদের পুকুরের ওপর মাচা ঘর তৈরি করে হাঁসের খামার গড়ে তোলেন। টিটো জানান, হাঁস খামারে ৩০০টি হাঁসের মধ্যে ছয়টি মাদা অর্থাৎ পুরুষ জাতের হাঁস রয়েছে। খাকি ক্যা¤পবেল জাতের হাঁসগুলো এরই মধ্যে ডিম দেওয়া শুরু করেছে। তাও আবার এক ডিমে দুই কুসুম। খামারটি পরিচর্যার জন্য রেখেছেন কর্মচারী। টিটো আরও জানায় হাঁসের বিষ্ঠা হচ্ছে মাছের খাবার। আর গরুর গোবর দিয়ে বায়োপ্ল্যান্ট করার ইচ্ছে রয়েছে তার। এসব থেকে বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করার স্বপ্ন দেখছেন। এলাকার বেকার তরুণদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান আলফ্রেড টিটো। এতে টিটোর দেখাদেখি এলাকার বেকার যুবকরাও নিজে নিজে কিছু করতে উৎসাহিত হবে। সৈয়দপুর উপজেলা প্রাণিস¤পদ কর্মকর্তা ডা. এনামুল হক বলেন, আলফ্রেড টিটোর হাঁসের খামার স¤পর্কে আমরা জেনেছি। তিনি যে জাতের হাঁস লালন-পালন করছেন তা খুব লাভজনক। এসব হাঁস নিয়ম করেই ডিম দেয়। এদিকে হাঁস বা মুরগির ডিম নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। তবে একসময় যে বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মতবাদ পাল্টে ফেলেছেন। বহুদিন পর্যন্ত ডিমকে ‘শরীরের শক্র’ বলে প্রচার করা হয়েছে। ডিম স্যালমোনেলা জীবাণুর উৎস, ডিম শরীরে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়- এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই এসেছে।কাজেই এখন ডিম নিয়ে বিজ্ঞানীদের মতবাদ পাল্টে যাচ্ছে কেন? ক’টা ডিম শরীরের জন্য ভাল? এখন বেশিরভাগ ডাক্তারই স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকায় ডিম রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, বেশিরভাগ পুষ্টিকর উপাদান প্রাকৃতিকভাবে যেসব খাবারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো ডিম। যেমন, ডিমে আছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, ভিটামিন এ, ডি, বি এবং বি-টুয়েলভ। এছাড়াও ডিমে আছে লুটেইন ও যিয়াস্যানথিন নাম দুটি প্রয়োজনীয় উপাদান যা বৃদ্ধ বয়সে চোখের ক্ষতি ঠেকাতে সাহায্য করে। ব্রিটিশ ডায়েটিক অ্যাসোসিয়েশনের ড. ফ্যাঙ্কি ফিলিপস্ বলছেন, ‘দিনে একটা- এমনকি দুটো ডিমও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।’ ‘বেশি ডিম খাওয়ায় ভয়ের কোন কারণ নেই।’ ড. ফিলিপস্ বলছেন, এখানে সতর্কবাণী শুধু একটাই - ‘একধরনের খাবার বেশি খেতে গিয়ে অন্য খাবারে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় যেসব পুষ্টি রয়েছে সেগুলো বাদ দেওয়া ভুল হবে।’ তিনি আরও বলছেন, ডিম যদিও ‘প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ একটা উৎস’, কিন্তু একটা ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আমাদের অন্যান্য খাবার থেকেও আমরা প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন পাই - যা অনেক সময়ই শরীরের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি। কাজেই ‘অতিরিক্ত প্রোটিন কিডনির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।’ ২০০৭ সালে ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা বলছে, কোলেস্টেরল বিষয়ে নতুন যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তার আলোকে সপ্তাহে তিনটির বেশি ডিম না খাওয়ার যে পরামর্শ তারা ২০০৭ সালে দিয়েছিল তা তারা তুলে নিয়েছেন। অপর দিকে দেখা যায়, অধিকাংশ স্বাস্থ্যসচেতন মানুষই ডিমের সাদা অংশ খেলেও ডিমের হলুদ অংশ অর্থাৎ কুসুম ফেলে দেয়। কিন্তু ডিমের কুসুমও শরীরের পক্ষে কতটা উপকারী তা অনেকেই জানেন না। এটা ঠিক যে ডিমের সাদা অংশের চেয়ে ডিমের কুসুমে অতিরিক্ত ক্যালোরি আছে, কিন্তু আপনার সাপ্তাহিক খাবারের তালিকায় ডিমের কুসুম থাকা মানে আপনার হাড় দীর্ঘায়ু হয়, ফলে বাতের ব্যথা বা এই ধরনের হাড়ের অসুখ চট করে হয় না। ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘কে’ আছে এই ভিটামিন কে-র ফলে হাড় শক্ত হয়। ডিমের কুসুমে কোলাইন মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করে। মনোগোর ও আলজাইমারের মতো রোগ হওয়ার প্রবণতাকে এড়ানো যায় ডিমের কুসুমের সাহায্যে। ডিমের কুসুম খেলে আরও মোটা হয়ে যেতে হয়। কিন্তু আদতে উল্টোটা। ডিম প্রচুর শক্তি আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ডিম রক্তে শর্করার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ব্রেকফাস্টে ডিম খেলে পেটটা অনেকক্ষণ ভর্তি থাকে। খিদে কম পায়। ডিমের কুসুমে ভিটামিন ডি রয়েছে। যার ফলে স্তন ক্যান্সার ও অন্ত্রের ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে। রক্তের জন্য রক্ত কণিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে ডিমের কুসুম। কোলোস্টেরল আমাদের যকৃৎ প্রচুর পরিমাণে কোলেস্ট্রল উৎপাদন করে। কিন্তু ডিমের কুসুম খেলে কম কোলেস্ট্রল উৎপাদন করে। ফলে শরীরে কোলোস্ট্রলের সমতা বজায় থাকে। ডিমের সাদার সঙ্গে কুসুমও খেলে শরীরের প্রদাহ সমস্যা কমে। লোহিত রক্ত কণিকা ও মস্তিষ্কের জন্য উপকারি ডিমের কুসুম। ডিমের কুসুম লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্তরকে বৃদ্ধি করে। এর ফলে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এ ছাড়া চোখের জন্য উপকারি। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডিম খেলে চোখের সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়। চোখে ছানি পরার সম্ভাবনাও কমে। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×