ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শেরপুরের জগৎপুর গণহত্যা দিবস আজ ॥ ৪৭ বছরেও হয়নি তালিকা

প্রকাশিত: ২২:১৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

শেরপুরের জগৎপুর গণহত্যা দিবস আজ ॥ ৪৭ বছরেও হয়নি তালিকা

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর ॥ আজ ৩০ এপ্রিল; শেরপুরের জগৎপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৩৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জগৎপুর গ্রাম। এতে ২শ’রও বেশি বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। স্ব^াধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও ওই গ্রামে শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিফলক। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর। শেরপুর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নে জগৎপুর গ্রামের অবস্থান। ১৯৭১ সালের ওই দিনে পাক বাহিনী আর দেশীয় দোসররা গ্রামটিকে ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেললে গ্রামের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশের রঙ্গবিলে। সেদিনের বর্বোরোচিত হামলায় ৩৫ জনের প্রাণ গেলেও ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও বেঁচে আছেন অনেকেই। সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতিচারণ করে বেঁচে থাকা কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, সেদিন ছিল বাংলা ১৬ বৈশাখ, ৩০ এপ্রিল শুক্রবার। সকাল ৮টার দিকে জগৎপুরের সামনের শংকরঘোষ গ্রাম থেকে স্থানীয় রাজাকার মজিবর, বেলায়েত, নজর ও কালামের সহযোগিতায় পাকবাহিনী জগৎপুরের ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাক বাহিনীর ৩টি দল গ্রামের ৩ দিকে গিয়ে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। ওইসময় গ্রামবাসী কোন কিছু না বুঝেই জীবন বাঁচাতে গ্রামের পেছনের দিকের রঙ্গবিলের দিকে দৌড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু বিলের মাঝখানে পানি থাকায় কেউ সাঁতরিয়ে, আবার কেউ বিলের দু’পাড় ঘেঁষে পালাতে যায়। ওই সময় শুকনো জায়গা দিয়ে পালাতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ৩৫ গ্রামবাসী। শুধু গুলি করে গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাক সেনারা। তারা জনমানুষ শূন্য গ্রামের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। ঘটনার প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পর পাক সেনারা চলে গেলে কিছু কিছু গ্রামবাসী ফিরে এসে দেখে তাদের বাড়ি-ঘরের স্থলে পোড়া গন্ধ ও ছাঁই ছাড়া আর কিছুই নেই। ওই অবস্থা দেখে অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। আবার অনেকেই নাড়ীর টানে পড়ে থাকে গ্রামেই। এদিকে হিন্দু-মুসলিম অনেকেই তাদের আত্মীয়দের লাশ গ্রামের একটি জঙ্গলের কাছে গণকবর দেয়। ওই গণকবরের পাশেই বর্তমানে হিন্দুদের শ্মশান ঘাট রয়েছে। কিন্তু ওই গণকবরের স্থানে আজও স্মৃতিফলক না করায় ক্ষোভ রয়েছে গ্রামবাসীর। জগৎপুরের কৃষক আব্দুস সামাদের ছোট ভাই আলফাজ ছিলেন মুৃক্তিযোদ্ধা। তিনি পার্শ্ববর্তী একটি ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছলে তার মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে গ্রামে ছুটে যান। ওইসময় তার সাথে ছিল আরও এক মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের মাসখানেক আগে স্থানীয় রাজাকাররা তার ভাই ও ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গেলেও আজও তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ওই গ্রামের গণহত্যা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম.ফিল গবেষক মোঃ রোকনুজ্জামান খান লিখেছেন ‘জগৎপুর গণহত্যা’। গণহত্যা নির্যাতন নির্ঘণ্ট বিষয়ক ওই গ্রন্থে একাত্তরের ৩০ এপ্রিল কারা, কীভাবে সেই ঘৃণ্যতম গণহত্যা-নির্যাতন সংঘটিত করেছিল নির্যাতিত, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে তা জানা যায়। জানা যায় শহীদদের নাম-পরিচয়, নির্যাতিতদের পরিচয় এবং বধ্যভূমি সংরক্ষণ, স্মৃতিরক্ষার প্রয়াস ও বর্তমান অবস্থা। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যের কয়েকটি রক্তভেজা পাতা, শহীদের আত্মদানের অশ্রুমাখা গাথা; সর্বোপরি মুক্তিসংগ্রামের মর্মন্তুদ কাহিনী। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছরেও সেখানে আজও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে শহীদদের নাম ফলক ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেইসাথে দেশের বিভিন্ন স্থানের রাজাকারদের বিচার হলেও জগৎপুরের ঘটনায় জড়িত রাজাকারদের বিচারে কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে। এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর অঞ্চলের গণহত্যার ইতিহাসে জগৎপুর আজও এক দগদগে ক্ষত। তিনি জগৎপুরে গণকবর সংরক্ষণ এবং শহীদদের নামফলক নির্মাণে পদক্ষেপ গ্রহণসহ জগৎপুর ট্র্যাজেডির নায়কদের বিচার দাবি করেন।
×