ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ জায়া মুক্তিসংগ্রামী বেগম মুশতারী শফি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

শহীদ জায়া মুক্তিসংগ্রামী বেগম মুশতারী শফি

১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে স্বামী দন্ত চিকিৎসক ডাঃ শফিকে হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে মুক্তির সংগামে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন বেগম শফি তা ভুলে যাবার মতো নয়। সাত সন্তানের জননী মুশতারী শফির পরিবারসহ সীমান্ত পাড়ি দেয়া তৎকালীন বাস্তবতায় এক লড়াকু অভিযাত্রা। তার সঙ্গে আলাপচারিতায়- নাজনীন বেগম ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর তা-ব সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও এর বিষবাষ্প সংক্রমিত হতে থাকে। বিভিন্ন কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চট্টগ্রামের একটি অন্যরকম অবদান নগরীর বিশিষ্টতা দানে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। চট্টগ্রামের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এমএ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে সংগ্রামী অভিযাত্রা তার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যুক্ত ছিল জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ আজিজের মতো ব্যক্তিত্বদের যুগান্তকারী ভূমিকা। সব থেকে বেশি করে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদের অনন্য, বৈপ্লবিক, স্মরণীয় কর্মযোগ যা মুক্তিসংগ্রামের সময়োপযোগী এবং আবশ্যকীয় সংযোজন। এরই ধরাবাহিকতায় আর এক সংগ্রামী ইতিহাস তৈরি করলেন চট্টগ্রামের বলিষ্ঠ নারী বেগম মুশতারী শফি, যিনি নারীদের মেধা আর মননের বিকাশে ‘বান্ধবী’ নামে একটি মহিলা মাসিক সাময়িকীও প্রকাশ করেছিলেন সেই ১৯৬৩ সাল থেকে। যা বাংলাদেশের ঐতিহাসের দ্বিতীয় সাময়িকী নারীদের জন্য। আমরা সবাই জানি ‘বেগম’ হলো মহিলাদের জন্য প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক নারী সাময়িকী। যার সম্পাদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। বেগম শফিকে নিয়ে লিখেছেন নাজনীন বেগম। ১৯৩৮ সালে জন্ম নেয়া বেগম মুশতারী শফি মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রত্যক্ষ করেন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সময়গুলো। ঢাকা কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ঐতিহাসিক ভাষাসংগ্রামের রক্তাক্ত পথপরিক্রমাকে লালন করে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্নে অবিচলিত থেকেছেন। ছোটবেলা থেকেই মননশীলতার সুপ্ত প্রতিভায় একটি সাংস্কৃতিক জগতও তৈরি হতে সময় নেয়নি। অর্থাৎ সব সময়ই লেখালেখির আঙ্গিনায় নিজের আদর্শিক চেতনাকে বিকশিত করেছেন। ‘বান্ধবী সংঘ’ প্রচার করতে গিয়ে মেয়েদের প্রেস নামে একটি ব্যতিক্রমী মুদ্রণ সংস্থাও গড়ে তুলেছেন। এই লড়াকু নারীকে সঙ্গত কারণে নামতে হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এক সশস্ত্র অভিঘাতের সাক্ষাত সমরে। কারণ ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার চূড়ান্ত রূপ নেয় ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর। স্বামী দন্ত চিকিৎসক শহীদ ডাঃ শফির এনায়েত বাজারস্থ বাসভবন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখার নিরাপদ জায়গা। শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের নির্বিঘ্ন স্থান যেখান থেকে কালুরঘাটে নিয়মিত সংযোগ স্থাপন করা হতো। সুতরাং মুক্তিসংগ্রামের এমন একটি সম্ভাবনাময় দুর্গকে আবিষ্কার করতে সে রকম সময় অপচয় করতে হয়নি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশীয় দালাল চক্রদের। যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডাঃ শফির বাড়িটা কড়া নজরে পড়ে যায় বর্বর সামরিকজান্তার। ৬ এপ্রিল প্রথম হানা দেয় পাকবাহিনী ডাঃ শফির বাসভবনে। ঐদিন শুধু স্বামীই নন, ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এহসানকেও ধরে নিয়ে যায় সামরিক বাহিনীর পাষ-রা। সেদিন অবশ্য তারা ফিরে এলেও চূড়ান্তভাবে পাকবাহিনীর কব্জায় চিরকালের মতো চলে যান তারা ৭ এপ্রিলে। এর পর স্বামী ডাঃ শফি কিংবা ছোট ভাই এহসানের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৭ সন্তানের জননী বেগম মুশতারী শফি হতবিহ্বল, দিশেহারা। চারটি মেয়ে এবং তিনটি ছেলে আর তার বাসায় কিছু আশ্রিতদের নিয়ে কী ভাবে রাতের অন্ধকারে নিজের বাসভবন ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তার রক্তাক্ত দলিল মূর্ত হয়ে আছে ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইটিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য বইটি শুরু করা হয় ৬ এপ্রিল থেকে কারণ ঐদিনই স্বামী আর ভাইকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ৭ এপ্রিল হয় তাদের চিরস্থায়ী প্রস্থান। এর পরবর্তী ইতিহাস এক লড়াকু নারীর প্রতিদিনের সংগ্রামী অভিঘাতের এক ক্ষতবিক্ষত জীবন প্রবাহ। স্বামীহারা এক অসহায় নারী তার অবোধ আর কিশোর-কিশোরী সন্তানদের নিয়ে কী ভাবে বাড়ককু-, মিরসরাই হয়ে ভারতের আগরতলা সীমানা পাড়ি দিয়েছিলেন কখনও পায়ে হেঁটে, কোন সময় রিকশায় এমনকি নৌকায় পর্যন্ত তাদের সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমা অব্যাহত ছিল। তার চেয়েও দুঃসহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল শরণার্থী শিবিরে নিজেরসহ সাত সন্তানের মানবেতর জীবনের এক করুণ অধ্যায়। ভারতে অনুপ্রবেশ করা অসংখ্য শরণার্থীর মাঝে প্রাথমিকভাবে নিজেদের স্থান করে নেয়া সত্যিই এক দুর্বিসহ অবস্থা। তার ওপর ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থা। ভারত সরকার নিজেই তখন বিব্রতকর অবস্থায় শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলায়। দেশী-বিদেশী ত্রাণসামগ্রী আসাও ছিল সময়ের ব্যাপার। এসব সঙ্কটকালীন সময়ের বাস্তবোচিত বর্ণনা আছে তার মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বইটিতে। এতসব টানাপোড়নের মধ্যেও এক উদ্দীপ্ত চেতনায় শাণিত হওয়ার মতো লড়াকু মানসিকতা গড়ে উঠতেও সময় লাগত না। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ থেকে আরম্ভ করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষাসৈনিক, সবার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে নিজেও এক সময় হয়ে গেলেন লড়াকু যোদ্ধা। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত তো ছিলই। মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পর পরিচিত হন আরও অনেকে বরেণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে, বিশেষ করে দুই বাংলার স্বনামধন্য লেখিকা আশাপূর্ণ দেবী, মৈত্রীয় দেবী এবং বিপ্লবী ইলামিত্রের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত জীবনের এক সময়োপযোগী শুভযোগ। যারা লড়াকু অভিযাত্রায় নিরন্তর সহযোদ্ধার ভূমিকায় পাশে থেকেছেন। শুধু পাশে থাকা নয় সংগ্রামী মননে উদ্দীপক হিসেবেও প্রয়োজনীয় অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই সব অতৃপ্ত অস্থিরতার সঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের সমন্বয়ে প্রতিটি প্রভাত ছিল নতুন সূর্যোদয়ের নব কিরণ। যে কিরণে উদ্ভাসিত হয়েছে এক কোটি শরণার্থী বাঙালী, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং কণ্ঠসৈনিকের দীপ্ত পথ পরিক্রমা। যা আনন্দ আর বিষাদের মিলিত আবহে এক বিচিত্র অনুভূতি যেখানে শুধু অনুভবই করা যায়Ñ আর কিছু নয়Ñ অন্য কিছু নয়। এম আর আকতার মুকুলের চরমপত্রের পঠন-পাঠন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যে সময়ানুগ সংযোজন তারও সাক্ষাত সাক্ষী বেগম মুশতারী শফি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চরম ভয়াবহতায় স্বামী আর ভাইকে হারিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমানো সাত সন্তানের জননী বেগম শফি নিজ দেশের তা-ব প্রত্যক্ষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ও তার প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখে সম্পূর্ণ লড়াইয়ের দুর্লভ গৌরবেরও অংশীদার। এমন নির্ভীক, লড়াকু নারীসৈনিক আগামী প্রজন্মের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়লেও অন্তর্নিহিত সংগ্রামী বোধে ছোট ছোট বাচ্চাদের স্নেহছায়ায় রেখে স্বাধীনতা অর্জনের দীপ্ত শপথে সমস্ত বাধা-বিঘ্ন কে অতিক্রম করতে এগিয়ে গেছেন নিঃসঙ্কোচে, সুদৃঢ় অবিচলতায়। সেই মুক্তিযুদ্ধের পতাকা যখন ধর্ষিত হয়, লুণ্ঠিত হয়, অমানবিক অপঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় এমন বেদনাও যে কখনো আসতে পারে সেটা বেগম মুশতারী শফির জানা-বোঝার বাইরে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, লাখো রক্তের আলপনায় অঙ্কিত লাল সবুজের সুচারু চিত্রকর্ম কখনও অপমানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যিক গৌরব আর মহিমা নিয়ে চিরদিন সসম্মানে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে।
×