
ছবি: সংগৃহীত
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ, বিশেষত বর্ষাকাল আসার পর থেকেই যেটি নিয়মিত এবং ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে দেখা দেয়। প্রতি বছর ভারত, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিচু ও নদীনির্ভর দেশ বাংলাদেশ। তাই প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা— এসব রাজ্যে যখন অতিবৃষ্টি ও বন্যা দেখা দেয়, তখন এটি শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও একটি সম্ভাব্য বিপদের পূর্বাভাস।
ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা। এই রাজ্যগুলো থেকে প্রবাহিত হয় অনেকগুলো বড় নদী, যেগুলো পরে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যেমন: গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার প্রভৃতি নদী ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষা মৌসুমে যদি এই নদীগুলোর উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তবে তার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে পড়ে। নদীগুলোর পানি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে প্লাবিত করে বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে।
ভারতের আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে প্রতিবছর বর্ষাকালে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি অতিরিক্ত বেড়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র নদ পরবর্তীতে বাংলাদেশে ‘যমুনা’ নামে প্রবাহিত হয়। উজানে যদি পানি বেড়ে যায়, বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন- গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং জামালপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাগুলো প্রায় প্রতিবছরই এই কারণে প্লাবিত হয়।
তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অতীতে ভারত বেশ কয়েকবার হঠাৎ করে তিস্তা ব্যারেজ থেকে পানি ছেড়ে দিয়েছিল, যা বাংলাদেশের রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং কুড়িগ্রাম জেলাতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। এই হঠাৎ পানি ছাড়া কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই দেওয়া হলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং কৃষি, বসতি ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যেও গঙ্গা, মহানন্দা ও তাদের উপনদীগুলোর মাধ্যমে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চলেও বন্যার ঝুঁকি বাড়ে।
আবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টির ফলে উৎপন্ন অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বিশেষ করে খোয়াই, ধলাই, মনু, গোমতী প্রভৃতি নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জলাবদ্ধতা ও বন্যা তৈরি করে।
এছাড়াও ভারতের অনেক রাজ্যে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে যা পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন ভারতে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয় এবং সেই পানি ধারণের ক্ষমতা কমে যায়, তখন হঠাৎ করে সেই বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। এই অনিয়ন্ত্রিত ও অঘোষিত পানি ছাড়া বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে প্রস্তুতির সুযোগ দেয় না। এটি শুধু কৃষি বা ঘরবাড়ির ক্ষতি করে না, বরং মানুষের প্রাণহানিরও কারণ হয় অনেক সময়।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠন ও নদীনির্ভরতার কারণে এমনিতেই প্রতি বর্ষায় বন্যার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যখন প্রতিবেশী দেশগুলো বিশেষত ভারত, তাদের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় একতরফা সিদ্ধান্ত নেয় বা পর্যাপ্ত তথ্য আদান-প্রদান না করে, তখন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি হয়ে উঠে এক প্রকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহু বছর ধরে পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও বাস্তবিক অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি এখনো ঝুলে আছে। ফলে বর্ষাকালে ভারত তিস্তার উজানে পানি আটকে রাখে, আর হঠাৎ করে অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ বন্যার কবলে পড়ে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু সীমান্তবর্তী নদীর পানি প্রবাহ ও বন্যা পরিস্থিতি যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কয়েকটি যৌথ নদী কমিশন আছে। তবে এসব কমিশনের কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বহুবার। প্রযুক্তি ও তথ্য আদান-প্রদানে ঘাটতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং সময়মতো সতর্কবার্তা না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের পক্ষে কার্যকর প্রস্তুতি গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে বৃষ্টিপাতের ধরণ এবং সময়ও বদলে যাচ্ছে। কখনো অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো দীর্ঘ খরার পর হঠাৎ বৃষ্টি হচ্ছে, যা আগাম বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়া, বনভূমি উজাড়, পাহাড় কাটা, অবৈধ দখল এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় সেখানে বৃষ্টির পানি সহজে জমে গিয়ে দ্রুত নীচের দিকে নেমে আসে, যার ফল ভোগ করতে হয় বাংলাদেশকেই।
বর্তমানে ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যেভাবে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের জন্যও তা সতর্কবার্তা বৈ কিছু নয়। ভারতের রাজ্যগুলোতে যেসব নদী প্লাবিত হচ্ছে, তার অনেকগুলোই বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ভারত যদি তার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় কিংবা হঠাৎ করে পানি ছাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা হতে পারে বড় ধরণের মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
বাংলাদেশের সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উচিত প্রতিবেশী দেশের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি ও নদীর জলপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়মিতভাবে মনিটর করা। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সমন্বিতভাবে আগাম সতর্কবার্তা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে যাতে হঠাৎ বন্যায় মানুষ ক্ষতির মুখে না পড়ে।
ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ঝুঁকির ঘণ্টা। শুধুমাত্র বৃষ্টিপাত নয়, বরং প্রতিবেশী দেশের নদীর গতিপথ, বাঁধের পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত এবং অবকাঠামোগত পরিকল্পনা বাংলাদেশের বন্যার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তাই এই সংকট মোকাবেলায় দরকার আন্তঃদেশীয় সমন্বয়, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা এবং সময়মতো তথ্য আদান-প্রদান— নইলে প্রতিবছরের মত এই বছরও বন্যা হবে আমাদের জন্য এক দুঃসহ স্মৃতি।
এম.কে.