
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি নিয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উল্লাস
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ। ক্রীড়াঙ্গনকেও যা নাড়িয়ে দিয়েছে, বিদীর্ন করেছে ক্রীড়াবিদদের বুক। সোমবার দুপুরে ঘটে যাওয়া দুঃসহ সেই শোককে রাতে শক্তিতে রূপান্তর করেছে মেয়েরা। অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ‘অঘোষিত ফাইনালে’ রূপ নেওয়া ম্যাচে প্রবল প্রতিপক্ষ নেপালকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলার বাঘিনীরা।
তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফয়সালার মঞ্চে জ্বলে উঠেছেন সাগরিকা। আসরে কেবল নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকই নয়, একে একে চারবার প্রতিপক্ষের জাল কাঁপিয়ে দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও থেকে উঠে আসা ১৭ বছর বয়সী তুখোড় এ উইঙ্গার। প্রথম দেখায় জয় পাওয়ায় শুধু ড্র করলেই চলবে, ঢাকার বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় এমন সমীরণের ম্যাচে অষ্টম মিনিটে দলকে এগিয়ে নেন সাগরিকা। দ্বিতীয়ার্ধে হয়ে ওঠেন আরও বিধ্বংসী। ৫২ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের পর ৫৮ মিনিটে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। এরপর ৭২ মিনিটে আরও একটি। আরও একবার শিরোপার উৎসবে অব্যাহত থাকল মেয়েদের সাফল্যের যাত্রা। ২০২৩ (অনূর্ধ্ব-২০) প্রথম আসরের ফাইনালে এই নেপালকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতির আসরে নেপালের সঙ্গে প্রথম দেখায় লাল কার্ডে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন সাগরিকা। সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তিনি ফিরলেন দারুণভাবে। গোটা ম্যাচেই নেপালকে তটস্থ রেখেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। গুরুত্ব বিবেচনায় শক্তিশালী একাদশ নিয়ে খেলছে পিটার বাটলারের দল। মাঠে খেলার আগে উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে দুই দলের খেলোয়াড়রা এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন। নীরবতা শেষে কিংস অ্যারেনাতে শুরু থেকে বাংলাদেশের দাপট চলতে থাকে। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে প্রথম গোলের সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
কাউন্টার অ্যাটাক থেকে বল পেয়ে সাগরিকা চেয়েছিলেন চিপ করে গোল করতে। সেটা কোনো মতে কর্নারের বিনিময়ে রুখে দেন নেপাল কিপার। পঞ্চম মিনিটে আবার স্বপ্নার কর্নারে সাগরিকার হেড গোল লাইন থেকে ক্লিয়ার করে সে যাত্রায় নেপালকে রক্ষা করেন আনিশা রাই। তবে তিন মিনিট পর সেই স্বপ্নার ডিফেন্স চেড়া থ্রæ ধরে ঠিকই গোল করেন সাগরিকা। প্রায় মাঝ মাঠ থেকে স্বপ্নার পাস নিয়ে অফসাইড ফাঁদ ভেঙে আক্রমণে ওঠেন বাংলাদেশের এই স্ট্রাইকার।
নেপালের আগুয়ান কিপার সুজাতা তামাং বক্স ছেড়ে বের হয়েও রুখতে পারেননি তাকে। গোলকিপারকে কাটিয়ে ডান পায়ের কোনাকুনি শটে বল ফাঁকা পোস্টে জমা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেন সাগরিকা। ১৯ মিনিটে বড় বাঁচা বেঁচে যায় বাংলাদেশ। কিপার মিলির গøাভস ফসকে একটি বল বেরিয়ে গেলে পূর্ণিমা রাইয়ের ভলি দূরের পোস্টে আঘাত করে ফিরে আসে। ফিরতি বলে সুক্রিয়া মিয়ার হেড মিলি সেভ করেন। দুই মিনিট পর বক্সের বেশ বাইরে থেকে মুনকির বাঁ পায়ের শট অনেকটা দৌড়ে গিয়ে গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করেন আনিশা রাই। বাকি অংশে স্বাগতিকদের পায়ে অধিকাংশ সময়জুড়ে বল থাকলেও ব্যবধান বাড়েনি।
দ্বিতীয়ার্ধে নেপালকে চেপে ধরে ২০২৩ সালে বয়সভিত্তিক এই টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের শিরোপা জেতা বাংলাদেশ। ৫২তম মিনিটে ব্যবধান হয় দ্বিগুণ। সতীর্থের পাস প্রথম স্পর্শে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটু এগিয়ে দারুণ শটে জাল খুঁজে নেন সাগরিকা।
এই গোলের রেশ থাকতেই হ্যাটট্রিক পূরণের উচ্ছ¡াসে ভাসেন সাগরিকা। মাঝমাঠ থেকে আসা লং ক্রস চিপ শটে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন এই ফরোয়ার্ড। শ্রীলঙ্কাকে ৯-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়া ম্যাচেও হ্যাটট্রিকের আনন্দে ডানা মেলেছিলেন তিনি। পায়ের কারিকুরিতে বল বের করে নিয়ে ৭৬তম মিনিটে গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করে ব্যবধান আরও বাড়ান সাগরিকা। একটু পরই তাকে তুলে নেন বাংলাদেশ কোচ পিটার জেমস বাটলার। বাকিটা সময়ে ব্যবধান আর না বাড়লেও ঘরের মাঠে শিরোপা ধরে রাখার আনন্দ সঙ্গী হয় বাংলাদেশের। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ শুরুটা করেছিল শ্রীলঙ্কাকে ৯-১ গোলে হারিয়ে। এরপর প্রবল প্রতিপক্ষ নেপালের বিপক্ষে ৩-২ গোলের ঘাম ঝরানো জয়ের পর ভুটানকে ৪-১ গোলে হারায় আফঈদারা।
পরের ম্যাচেই ভুটানের বিপক্ষে ফিরতি দেখায় জয় ৩-০ গোলে। আর ফিরতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারায় ৫-০ গোলে। ১৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থাকলেও হেরে গেলে গোল গড়ে স্বপ্নভঙ্গ হতো মেয়েদের। কারণ প্রতিপক্ষ গোল ব্যবধানে বেশ এগিয়ে ছিল। ভুটানকে ৮-০ গোলে হারানোয় নেপালের মোট গোল ৩০টি। আসরে ৪ গোল হজম করার দলটির গোল পার্থক্য ছিল প্লাস ২৬। একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ৫-০ গোলে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। তবে গোলে বড় ব্যবধানে এগিয়ে নেপাল। পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল দিয়েছে ২৪টি ও খেয়েছে প্রতিপক্ষের সমান ৪টি। সব মিলিয়ে পার্থক্য প্লাস ২০। অর্থাৎ বাংলাদেশ পয়েন্টে সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও ৬ গোলে পিছিয়ে ছিল। সেক্ষেত্রে ট্রফি ধরে রাখতে ড্র ছাড়া বিকল্প ছিল না। কিন্তু অদম্য মেয়েরা দাপুটে জয় দিয়েই শেষটা রাঙিয়ে রাখল।
২০১৮ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব-১৮ বয়সভিত্তিক পর্যায়ে হয়েছিল নারী সাফ। সেবার বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। এরপর কখনো অনূর্ধ্ব-১৯, কখনো অনূর্ধ্ব-২০ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে ভারত দুইবার চ্যাম্পিয়ন আর একবার রানার্সআপ তারা। ২০২৩ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম সংস্করণে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। শামসুন্নাহার জুনিয়রদের দারুণ পারফরম্যান্সের সৌজন্যে নেপালকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা মুকুট পরে তারা। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এবার বাংলাদেশে খেলতে আসেনি ভারত। ফলে বাংলাদেশই ছিল হট-ফেভারিট। শেষটাও হলো ফেভারিটের মতো। শোকের দিনে শিরোপা জিতলেন আফঈদারা।
প্যানেল মজি