
ছবি: সংগৃহীত
লিওনেল মেসি যখন ২০২৫ সালের জুনে ৩৮ বছরে পা রাখলেন, তখন পিএসজি ক্লাবের অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া তাকে শুভেচ্ছা জানায় এবং মজার ছলে বলে, “See you Sunday।” কিন্তু পিএসজি সমর্থকদের অনেকেই এই বার্তায় বিরক্ত হন, কারণ তাদের কাছে মেসির পার্ক দে প্রিন্সে সময়টা কোনোভাবে স্মরণীয় নয়। মেসি নিজেও পরবর্তীতে তার সেই অধ্যায়কে একটি হতাশাজনক অভিজ্ঞতা বলে আখ্যা দেন। এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপে পিএসজি বনাম ইন্টার মায়ামি ম্যাচকে অনেকেই দেখছেন একটি প্রতীকী "গ্রাজ ম্যাচ" হিসেবে।
মেসি আসলে কখনোই পিএসজি-তে যোগ দিতে চাননি। তার লক্ষ্য ছিল বার্সেলোনাতেই ক্যারিয়ার শেষ করা। ক্লাবটি ছিল তার প্রকৃত বাসস্থান। তিনি তার জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন কাতালুনিয়ায়, সেখানেই পরিবার গড়েছেন। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট বার্তোমেউর আর্থিক অব্যবস্থাপনা ক্লাবকে এমন অবস্থায় ফেলে দেয়, যেখানে নতুন চুক্তির জন্য আর্থিক অবস্থা বার্সার ছিল না। এ কারণে হোয়ান লাপোর্তা আর কোনো উপায় না দেখে মেসিকে ছাড়তে বাধ্য হন। এই বিদায় ছিল অত্যন্ত আবেগঘন, যেদিন মেসি সংবাদ সম্মেলনে কেঁদে ফেলেন — এমন দৃশ্য লুইস সুয়ারেজও আগে কখনো দেখেননি।
এই আবেগঘন বিদায়ের পর মেসি যে সিদ্ধান্ত নেন, তা ছিল তাড়াহুড়ো করে নেওয়া। তিনি নিজেই পরবর্তীতে বলেন, পিএসজিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দ্রুতই নেওয়া হয়েছিল। যদিও বন্ধু নেইমারও কিছু স্প্যানিশভাষী খেলোয়াড় থাকায় মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে ভেবেছিলেন, বাস্তবে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তিনি দুই বছরের মধ্যে এমন ব্যক্তিগত অখুশির সময় কাটান, যা তার খেলোয়াড়ি জীবনে বিরল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০২২ সালের বিশ্বকাপ জয়।
পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পর মেসি মানসিকভাবে পুরোপুরি স্থির হতে পারেননি। কোপা আমেরিকার পর তিনি পুরো প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতি পাননি, আবার মাঝপথে করোনা আক্রান্ত হন। পরিবারের জন্য প্যারিসে উপযুক্ত বাসা খুঁজে পেতে সময় লেগে যায়, ফলে তারা ছয় সপ্তাহ হোটেলে কাটায়। তিনি নিজেই বলেন, তার সন্তানরা মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিল। এসব মিলিয়ে মাঠে তার পারফরম্যান্সেও প্রভাব পড়ে — প্রথম মৌসুমে মাত্র ১১টি গোল করতে পারেন, যা তার ক্যারিয়ারের সর্বনিম্ন রেকর্ড।
পিএসজি সমর্থকরা মেসির বার্সার প্রতি গভীর ভালবাসা জানতেন। তবু তারা আশা করেছিলেন, তিনি ক্লাব ও ভক্তদের সঙ্গে অন্ততপক্ষে কিছু সম্পর্ক তৈরি করবেন। কিন্তু মেসি নিজে বলেন, কেন তার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল, তিনি জানেন না — যদিও মাঠে বা মাঠের বাইরে তা বোঝা গিয়েছিল স্পষ্টভাবে। তিনি খুব কম সময় সমর্থকদের ধন্যবাদ দিয়েছেন, এবং একমাত্র একটি ম্যাচেই গ্যালারিতে যান, তাও নেইমারের বলায়। ফলে পিএসজি সমর্থকরা তাকে লক্ষ্য করে ক্রমেই বিদ্রূপ ও হুইসেল দেওয়া শুরু করেন। তার চূড়ান্ত বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স দেখার পর তারা ক্ষুব্ধ হন — এত ভালো খেলোয়াড় পিএসজির হয়ে এমন পারফরম্যান্স দেখাতে পারলেন না কেন?
পিএসজি সমর্থকদের অনেকেই মনে করেন, মেসির মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ, আর পিএসজিতে যোগ দেওয়া ছিল শুধুই একটি আর্থিক চুক্তি। অনেকেই বলেন, তিনি ছিলেন একটি “মার্কেটিং চুক্তি” — বাস্তব খেলোয়াড় নয়। পিএসজির ‘ব্লিং-ইনফ্লেটেড’ বা বাজারভিত্তিক তারকা নির্ভর নীতির প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। নেইমার, মেসি ও এমবাপে— তিনজনের মধ্যে কেউই রক্ষণে দায়িত্ব নেন না, ফলে মাঝমাঠের খেলোয়াড়রা বাড়তি চাপ অনুভব করেন এবং দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। মেসির দুই মৌসুমেই পিএসজি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে শেষ ষোলোতেই বাদ পড়ে।
এত কিছুর পরও পিএসজি মেসিকে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দেয়, তবে সেটি প্রধানত বাণিজ্যিক কারণে। কিন্তু মেসি নিজেই চুক্তি নবায়নে রাজি হননি। এতে পিএসজির ট্রান্সফার নীতিতে পরিবর্তন আনার সুযোগ তৈরি হয় — যার মধ্যে এমবাপের ক্লাব ছাড়া এবং তরুণ খেলোয়াড়দের ওপর বিনিয়োগ অন্যতম। ফলাফল হিসেবে, পিএসজি অবশেষে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। প্রেসিডেন্ট আল-খেলাইফি পরবর্তীতে স্বীকার করেন — মেসিকে সই করানো ছিল একটি ভুল, কিন্তু সেই ভুল থেকেও শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
মেসির পিএসজি অধ্যায়কে বলা যেতে পারে আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় ‘রিবাউন্ড রিলেশনশিপ’। এই সম্পর্কের শুরু ছিল আবেগ ও অর্থে গড়া, কিন্তু শেষ হয়েছে বাস্তবতা ও বিচ্ছেদের মাধ্যমে — এবং এই বিচ্ছেদ ছিল দুই পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক।
আবির