ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১

সালাউদ্দিনের মসনদে বসছেন কে?

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ৯ অক্টোবর ২০২৪

সালাউদ্দিনের মসনদে বসছেন কে?

বাঁ থেকে তরফদার মো. রুহুল আমিন, ইমরুল হাসান ও তাবিথ আউয়াল

আর মাত্র ১৭ দিন। তারপরই কাজী মো. সালাউদ্দিন অধ্যায়ের ইতি ঘটবে। আগামী ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পরেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এই সভাপতি দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন নতুন কারোর হাতে। হয়তো সেই ক্ষণটিতে তার মনে পড়তে পারে রবীন্দ্র সংগীতের সেই গানের লাইন দুটি, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা!’ তার আগ পর্যন্ত দেশের সব ক্রীড়ামোদীদের মনে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার, ‘সালাউদ্দিনের মসনদে বসছেন কে?’
বহুল আলোচিত নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেছে বাফুফে। ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সোমবার বাফুফে ভবনে এই তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মেজবাহ উদ্দিন। মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হবে বুধবার থেকে। চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। বাফুফে ভবনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন গ্রার্থীরা। তবে ১১ অক্টোবর পূজা উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় ওই দিন নির্বাচন সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। 
সভাপতি পদে মনোনয়ন পত্রের মূল্য এক লাখ, সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে ৭৫ হাজার, সহ-সভাপতি পদে ৫০ হাজার ও সদস্য পদে ২৫ হাজার টাকা। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে ১৪ ও ১৫ অক্টোবর দাখিল করতে হবে। মনোনয়নপত্র যাচাই বাচাই হবে ১৬ অক্টোবর। 
মনোনয়নপত্রের ওপর আপত্তি থাকলে ৫০ হাজার টাকা ফি দিয়ে ১৭ অক্টোবর আপিল করার সুযোগ রয়েছে। পরদিন হবে শুনানি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য নির্বাচন কমিশন দেড় দিন সময় দিয়েছে। তা হলো ১৯ থেকে ২০ অক্টোবর দুপুর ২টা পর্যন্ত। 

২০ অক্টোবর বিকালে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও ব্যালট নির্ধারণ করবে। ২৬ অক্টোবর ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সকালে বাফুফের বার্ষিক সাধারণ সভা। ওইদিনই দুপুর ২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। ভোটগ্রহণ শেষে শুরু হবে গণনা। বাফুফেতে সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, চার সহ-সভাপতি ও ১৫ নির্বাহী সদস্যসহ ২১টি পদের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন  ১৩৩ কাউন্সিলর।

এর আগে বাফুফের ভোটার ছিলেন ১৩৭ জন। এদের মধ্যে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ৬২, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের ক্লাবগুলোর ৩৪, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ১০, বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ৮, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ৫, শিক্ষা বোর্ডের ৫, নারী ফুটবল ক্লাবের ৪, ফুটবল কোচেস অ্যাসোসিয়েশন, ফুটবল রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ১টি করে ভোট।
আজকের আগ পর্যন্ত বাফুফের সভাপতি পদে অফিসিয়াল ক্যান্ডিডেট ছিলেন দুজন। কাকতালীয়ভাবে দুজনেরই নামের শুরুর আগে ‘ত’ রয়েছে। তারা হলেনÑ তরফদার রুহুল আমিন ও তাবিথ আউয়াল। ২০১২ ও ২০১৬ সালে বাফুফের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তাবিথ। ২০২০ সালে একই পদে হেরে যান। টানা চতুর্থবার নির্বাচন করতে যাচ্ছেন তিনি। নিজেই বলেছেন, ‘গত তিনটি নির্বাচন করেছি। এবারও লড়ব। আর সেটা সভাপতি পদে। আমি আশাবাদী জিতব।’ তাবিথ আরও বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থিতা পেশ করে আমার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে জানাব। নির্বাচনি ইশতেহারের ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে চাইছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি সভাপতি হলে খেলার মাঠে চমক দেখাব। ফুটবলকে পরের ধাপে নিতে পারব আশা করি।’
আগের দুই মেয়াদে বাফুফেতে সহসভাপতি হিসেবে কাজ করতে নির্বাহী কমিটি ও রাষ্ট্রের বাধা পাননি বলে জানান তাবিথ। দ্বিতীয় মেয়াদে বাফুফের টেকনিক্যাল কমিটি চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সময়ে দেশে ৪০০ কোচ তৈরি হয়েছে, দাবি করেছেন তাবিথ।
ঐকমত্যের প্যানেল হবে কি না, এমন প্রশ্নে তাবিথ বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনকে স্বাগত জানাবেন তিনি। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে, আরও দুই-একজন সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তাবিথ আগে দেখতে চান কারা আসেন। তারপর প্যানেল করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
তাবিথের আরও পরিচয় আছে। তিনি ব্যবসায়ী ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনে মেয়র পদে লড়াই করেছেন দুবার। ফুটবল সংগঠক। প্রিমিয়ার থেকে বিদায় নেওয়া ফেনী সকারকে এক সময় পৃষ্ঠপোষণা করেছেন, এখন করছেন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরের ক্লাব নোফেলে স্পোর্টিংকে। 
সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন তরফদারও। ঐকমত্যের ভিত্তিতে ব্যানারে লিখে তরফদারের সভাপতি পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাটি দেন অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ফোরাম কর্তা অ্যাডভোকেট আলী ইমাম তপন।
তপন বলেন, ‘জেলা ও ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে তরফদার রুহুল আমিনকে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। ফুটবল ফেডারেশন জেলা পর্যায়ে লিগ পরিচালনা করতে সহায়তা করেনি। উনার সহায়তায় জেলায় লিগ হয়েছে।’
তরফদার জানান, ‘যে ঘোষণা তারা দিয়েছেন, তা সাদরে গ্রহণ করলাম। ফুটবলের সেই দিনগুলো নেই, হারিয়ে গেছে। ২০০৮ এর পর ফুটবল তলানিতে গেছে। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দল। এরপর থেকে হারতে হারতে নিচের দিকে আছি। আজ র‌্যাঙ্কিং ১৮৪-তে এসেছে। এখান থেকে দলকে ওপরে উঠানো কঠিন। মাঠের খেলা টেবিলে চলে এসেছে। সারা দেশে এর চর্চা হলে ঠিকই বিশ্ব মানচিত্র জায়গা করে নেওয়া যেত। গত ১৬ বছর ফুটবলকে জাগতে দেওয়া হয়নি।

ফুটবল নিয়ে অনেক কাজ করেছি, জেলা ও বিভাগে। প্রচুর খেলোয়াড় উঠে এসেছে। ওই সময় প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করেছি। বাফুফে চায়নি আমরা কাজ করি। ১৮ কোটি দেশের লোক সীমানা পার হতে পারি না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কাউকে দোষ দিতে চাই না। ২০২০ সালে প্যানেল তৈরি করে এগোলাম। দেশেও থাকতে পারলাম না। অনেক ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে। এজেন্সি দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। সাইফ স্পোর্টিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে তৃণমূল পর্যায়ে শুরু করব। ফুটবলকে এসি রুমে রাখব না। বিকেন্দ্রীকরণ করব। নতুন করে জাগরণ তৈরি করব। চার বছরে কী করব, সেটাও বলব।’
এই দুজনের বাইরেও আরেকজনের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তিনি বাফুফের বর্তমান সহসভাপতি ও বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় গেল অর্ধযুগে এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে বারবার করে অংশ নিয়ে বসুন্ধরা কিংস নিজেদের নামটি এশিয়ার উঁচু স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছে। এমনকি সর্বকালের সেরা ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর আল নাসেরের সঙ্গেও এক দুই বছরে সাক্ষাৎ তথা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বসুন্ধরা কিংসের! সেক্ষেত্রে অনেকের মতে- সেই ক্লাবটির অদম্য সত্তা ও নেতা ইমরুল হাসান বাফুফের সভাপতি হলে মন্দ হয় না। তেমন মত রাখছেন বর্তমান ও সাবেক জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা। যদিও তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে। কারণ, তাদের কেউ কেউ আবার আসন্ন নির্বাচনের কাউন্সিলরও বটে।
এদিকে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যেই তরফদারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আসন্ন বাফুফে নির্বাচনে দেশের ক্লাব ফুটবলে সাফল্যের বিচারে আধিপত্য বিস্তার করা বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসানের সঙ্গে তাবিথ আওয়ালের মধ্যেই লড়াই হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সার্বিক প্রেক্ষাপটের আলোকে অনেকের মতে-তরফদার নির্বাচন থেকে পুনরায় সরে যেতে পারেন। লড়াই শেষ মুহূর্তে তাবিথ আওয়াল করবেন। কিন্তু তিনি কি ইমরুলকে হারাতে পারবেন? অতীত সাক্ষ্য দিচ্ছে, তিনি বাফুফে নির্বাচনে সহসভাপতির নির্বাচন করেও হেরে বসেছিলেন (২০২০ নির্বাচনে)।
এখন দেখার বিষয়, শেষ পর্যন্ত সালাউদ্দিনের মসনদে আসীন হন কে।

×