ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

দেশের প্রথম প্রবাসী এই নারী ফুটবলারের বাবা বাংলাদেশী, মা জাপানি

জাতীয় দলে ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন সুমাইয়া

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

জাতীয় দলে ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন সুমাইয়া

সুমাইয়া

অন্তত চারটি ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ‘প্রথম’। প্রথমত, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে প্রথম জাপানি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়। দ্বিতীয়ত, তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী ফ্রিস্টাইলার ফুটবলার। তৃতীয়ত, তিনিই এখন পর্যন্ত প্রথম ও একমাত্র ফুটবলার, যিনি কোন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে না খেলেই সরাসরি সিনিয়র জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। এবং চতুর্থত, তিনিই বাংলাদেশের নারী ক্লাব ফুটবলের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি একটি ক্লাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রথম মৌসুম কোনো ম্যাচ না খেলে শুধু অনুশীলন করেছেন। 
যার ব্যাপারে এত তথ্যের অবতারণা, চোহারার কারণে শুরুতে তাকে অনেকেই চাকমা বা মারমা জাতির মেয়ে ভেবেছিলেন! পরে জানা গেল তিনি জাপানি বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী। নাম মাতসুশিমা সুমাইয়া। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী সুমাইয়ার প্লেয়িং পজিশন হচ্ছে ফরোয়ার্ড। শারীরিক গড়নে বেশ এগিয়ে বাংলাদেশী মেয়েদের চেয়ে। গত ৪ ডিসেম্বর তার আরেকটি ‘প্রথম’ ফ্যাক্টর পাওয়া গেছে, যেটি তার একান্তই ব্যক্তিগত। সেটি হচ্ছে লাল-সুবজের জার্সিতে অর্থাৎ জাতীয় দলের হয়ে এই প্রথম গোল করেছেন তিনি (বিপক্ষ সিঙ্গাপুর, ভেন্যু-কমলাপুর স্টেডিয়াম)। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ জেতে ৮-০ গোলে। ম্যাচের ৮৭ মিনিটে প্রতিপক্ষকে ‘সেভেন-আপ’ উপহার দেয় লাল-সবুজ বাহিনী। সাবিনার ফ্রি কিক বক্সের ভেতরে হেড করেন আফেইদা খন্দকার। বল পান বদলি মাতসুশিমা সুমাইয়া। ডান পায়ে জোরালো শটে লক্ষ্যভেদ করেন তিনি (৭-০)। জাতীয় দলের হয়ে এটি ছিল সুমাইয়ার সপ্তম ম্যাচ। 
সুমাইয়া জাপানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২০০১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তার মা মাতসুশিমা তোমোমি জাপানি। তবে বাবা মাসুদুর রহমান বাংলাদেশী। দুই বছর বয়সে সুমাইয়া প্রথমবার তার পিতৃভূমিতে আসেন। ২০০৮ সালে তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন বাংলাদেশে। 
শৈশব থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল সুমাইয়া। জাপানে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সি ব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর ডন বস্কো স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্থানান্তরিত হন। ২০১৮ সালে তিনি একটি ফুটবল দল গঠন করেন এবং ইন্টার-ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তার দল ৬ বার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে টানা চার বারই শিরোপা জেতে। প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় হন সুমাইয়া। তিনি এরপর আইএম সি স্পোর্টিং একাডেমিতে খেলেন।
তার পেশাদার ফুটবল যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে, যখন বসুন্ধরা কিংসের একজন নির্বাচক তাকে খেলতে দেখেন এবং ক্লাবে তার নাম প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া তিনি মালদ্বীপে ফুটবল খেলা শুরু করেন। সাবিনার সঙ্গে ডিএসসিতে খেলেছেন সুমাইয়া। তিনি এবং সাবিনা জুটি পুরো টুর্নামেন্টে ওই দলের আক্রমণভাগের নেতৃত্ব দেন। শেষ পর্যন্ত তাদের ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ফাইনাল ম্যাচের সমাপনী গোল করেছিলেন সুমাইয়া। 
একজন নারী ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখতেন সুমাইয়া। সৌভাগক্রমে এই ফুটবল প্রতিভার ওপর শুরু থেকেই নজর রাখছিল বাফুফে। জাতীয় নারী দলের তৎকালীন ও নারী ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন সুমাইয়াকে বাফুফে ভবনে আমন্ত্রণ জানান। ট্রায়াল দেন সুমাইয়া। মুগ্ধ করেন কোচকে। সেটা ২০২০ সালের কথা। কিন্তু তার আগের বছরই তিনি ইনজুরিতে পড়েছিলেন। তার লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা তাকে আবার ফুটবল না খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু জেদি সুমাইয়া সেটা মানেননি। করোনাকালেও ও প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা অনুশীলন করেছিলেন তিনি। 
ট্রায়ালে টিকলেও তখনই জাতীয় দলে ডাক পাননি সুমাইয়া। কারণ তখন তার পজিশনে গিজগিজ করছে একাধিক মানসম্পন্ন ও পরীক্ষিত ফুটবলার। ফলে খেলার সুযোগই নেই! তাই দলের সঙ্গে রেখেই তাকে অনুশীলন করানো হয়। একই ঘটনা ঘটে বসুন্ধরা কিংসেও। তবে ততদিনে পরিশ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন কিংসের কোচ আবু ফয়সাল আহমেদের। ২০২১ সালে সব ম্যাচ খেলতে না পারলেও দলের ১৩টির মধ্যে ৩টি ম্যাচ খেলেন সুমাইয়া। একটি ম্যাচে কাক্সিক্ষত ‘প্রথম’ ক্লাব-গোলেরও দেখা পান (২০২১ সালের ১৭ জুলাই)। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো মাঠে নামার সুযোগ হয় সুমাইয়ার। সেটা নেপালের বিরুদ্ধে, এ বছরের ১৫ জুলাই। এরপর আরও ৫টি ম্যাচ খেললেও গোলের দেখা পাননি। অবশেষে সপ্তম ম্যাচেই পেলেন কাক্সিক্ষত ‘প্রথম’ গোলের দর্শন।  
সুমাইয়ার প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো আর প্রিয় ফুটবল দল ব্রাজিল। ভবিষ্যতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতার স্বপ্ন দেখেন তিনি। আগামী বছরের অক্টোবরেই সেই আসর। সুমাইয়ার সাফ-জয়ের স্বপ্ন তখন পূরণ হবে কি?

×