লিটন কুমার দাস
বিশ্ব ক্রিকেটে সহ-অধিনায়কের পদটি এখন আর শুধু আলঙ্কারিক নয়। এত খেলার চাপ, ভবিষ্যতের ভাবনা মিলিয়ে বাস্তবতা। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডসহ বেশিরভাগ দলই অধিনায়কের ডেপুটি বেছে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা ব্যতিক্রমই ছিল। ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ, বছরের পর বছর এক অধিনায়ক নিয়ে মাঠে নেমেছে টাইগাররা। খেলা চলাকালে প্রকৃতির ডাকে বা অন্য কারণে অধিনায়ক মাঠের বাইরে গেলে তাৎক্ষণিক কাউকে দায়িত্বটা দিতে হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি মুমিনুল হক সরে দাঁড়ালে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে সাকিব আল হাসানের প্রত্যাবর্তন হয় এবং প্রথম আনুষ্ঠানিক সহ-অধিনায়ক পায় বাংলাদেশ।
সাদা পোশাকে তার ডেপুটি করা হয় লিটন দাসকে। গত ডিসেম্বরেই তামিম ইকবাল চোটে পড়লে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন ইনফর্ম এ উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। ইনজুরির কারণে ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের সঙ্গে একমাত্র টেস্টে খেলছেন না সাকিব। সহ-অধিনায়ক লিটন দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে তিনি আগ্রহী নন! চাপ অনুভব করছেন, ব্যাটিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পরে অবশ্য খোদ বোর্ড (বিসিবি) প্রধান নাজমুল হাসান জানিয়েছেন লিটনই এই টেস্টের অধিনায়ক।
অতীতে অনেক রথী-মহারথীকেও দেখা গেছে, অধিনায়ক হওয়ার পর পারফর্ম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং পরে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
ক্রিকেটে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু লিটন যদি সত্যি চাপ অনুভব করেন তবু কেন তাকে জোর করা? যেখানে বোর্ড পরিচালক আকরাম খান নিজেই বলছেন, পাঁচ-ছয় জন আছেন যারা ভবিষ্যতে অধিনায়ক হতে পারেন! ‘এটা তো পুরোপুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত। বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে কে ক্যাপ্টেন হবে। এমনিতে কিছু ফিউচার প্লেয়ার তো আছেই। যখনই এদের পিক করা হয়েছিল, কিছু প্লেয়ারের নেতৃত্বগুণ থাকে, এইগুলো এদের মধ্যে আছে। প্রায় পাঁচ-ছয় জন ক্যান্ডিডেট আছে। এটা ডিপেন্ড করছে কারেন্ট ক্যাপ্টেন যে আছে, সিলেক্টর, কোচ আছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবে।’ ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসানের ওপর আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ তড়িঘড়ি করেই মুমিনুল হককে টেস্ট অধিনায়ক করা হয়েছিল। সাকিবের ওই মেয়াদের তাঁর কোনো ডেপুটি ছিলেন না।
নিয়মিত অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে কে দল পরিচালনা করবেন, সেটি তাই অস্পষ্টই ছিল। গত বছর মুমিনুল দায়িত্ব ছাড়ার পর বোর্ড (বিসিবি) প্রধান নাজমুল হাসান বলেছিলেন, ‘টেস্টেও (সহঅধিনায়ক) ছিল না, কোনো সংস্করণেই ছিল না। আজ সিদ্ধান্ত হয়েছে, টেস্টে একজনকে দেব। টেস্টে লিটনকে দিয়েছি, ফলে সামনে ওয়ানডে ও টি২০তেও দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে কাউকে।’ সম্ভাব্য টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তিনজনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিল বিসিবি। সেই তালিকাতেও ছিলেন লিটন। প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আরও দুটি নাম এসেছিল। লিটনের বাইরেও আরেকটি নাম এসেছিল। এমনকি কে অধিনায়ক হবে, সেটিও নিশ্চিত ছিল না। তিনজনের মধ্যে একজনকে অধিনায়ক ও একজনকে সহ-অধিনায়ক করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত ছিল। সাকিব যদি না হতো, তাহলে এখানে অন্য দুজন হতো অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক।’
লিটনের প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান তিনি। ২০২২ বছরটি কেটেছে স্বপ্নের মতো। বাংলাদেশী ব্যাটার হিসেবে এক বছরে রেকর্ড ১ হাজার ৯২১ রান করেছেন। গত বছরে ৪২ ম্যাচে লিটনের ব্যাটে ছিল ১৩ ফিফটি ও তিনটি সেঞ্চুরি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে এর আগে শুধু মুশফিকুর রহিম ১ হাজার ৬৫৭ রান করেছিলেন। ২০২২ এ মুশফিককে ছাড়িয়ে যাওয়া লিটনের সামনে ছিলেন শুধু পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম। বাবর করেন ২ হাজার ৪২৩ রান। এই সাফল্যটা ২০২৩-এও ধরে রেখেছিলেন লিটন।
বিপিএলটা খুব ভালো না কাটলেও আন্তর্জাতিকে ভারত, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে রান পেয়েছেন। কিন্তু ভালো পারফর্মার মানেই যে ভালো অধিনায়ক হওয়ার সম্ভাবনা- এমন নয়। সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন যেমন লিটন প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ‘এখনই বলাটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, সত্যি কথা বলতে গেলে লিটন খুবই অন্তর্মুখী একজন ক্রিকেটার। আমি সব সময় এক্সট্রোভার্ট পছন্দ করি। আমি বলব, লিটন বেশ পরিষ্কার মাথার একজন। ওর ক্রিকেট জ্ঞান খুবই ভালো। যেটা বললাম যে, এটাতো আসলে এমন কাউকে দিতে হবে যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে।’ সুজনের মতে শুধু ব্যাট হাতে পারফরম্যান্স দেখানোই অধিনায়কত্ব পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
এর সঙ্গে আরও বেশ কিছু গুণাবলী থাকা বাঞ্ছনীয়, ‘ব্যাট হাতে রান করাতো অবশ্যই (দরকার), মাঠের পারফরম্যান্স তো অবশ্যই লাগবে। সঙ্গে ড্রেসিং রুমের পরিবেশটা সামলানোও গুরুত্বপূর্ণ। দলের সংস্কৃতি উন্নতি করাটাও জরুরী। এ ক্ষেত্রে অধিনায়কের ভূমিকাটা অনেক বেশি থাকে।’ আকরামের মতো পাঁচ-ছয় জন না হলেও ভবিষ্যৎ অধিনায়কের ভাবনায় আছেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাজমুল হোসেন শান্ত এবং নুরুল হাসান সোহান। অলরাউন্ড সামর্থ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বড় দাবিদার মিরাজ।
২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলেও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। ৬ ম্যাচে করেন ২৪২ রান। নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। বিপিএলেও রাজশাহী কিংস ও চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে মিরাজের। বিসিবির সুনজরে থাকা আরেক ক্রিকেটার নাজমুল হোসেন শান্ত ঘরোয়া পর্যায়ে ক্যাপ্টেন্সি করেছেন ২০২০ সালে। করোনা পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্টস কাপ দিয়ে মাঠে খেলা ফিরিয়েছিল বোর্ড (বিসিবি)। সেবার তামিম, মাহমুদউল্লাহ ও শান্তরর নেতৃত্বে ৩টি দলকে নিয়ে হয়েছিল টুর্নামেন্ট। যেখানে দল ফাইনালে উঠলেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে আলো ছড়াতে পারেননি শান্ত। ৫ ম্যাচে করেছিলেন মোটে ৬৯ রান। আর আলোচনায় থাকা আরেক জন সোহানেরও অভিজ্ঞতা আছে ঘরোয়া ক্রিকেটে। ক্যাপ্টেন হিসেবে ব্যাটিং পারফরম্যান্স দুর্দান্ত তার।
১৪ জুন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ১২তম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামবেন লিটন দাস। যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ২০০ সালে। স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। ৭টি টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ১২ টেস্টে দায়িত্ব পালন করে খারেদ মাসুদ পাইলট। ২০০৩ সালে ৯ টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সাদা পোশাকে নেতৃত্ব দেন হাবিবুল বাশার সুমন।
২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোহাম্মদ আশরাফুল ছিলেন ১৩ টেস্টের দায়িত্বে। ওই বছর একটি মাত্র টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত একাধিকবার দায়িত্বে ফেরা সাকিব আল হাসানের অধীনে ১৯টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩৪ টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মুশফিকুর রহিম। ২০১৭ সালে একটি টেস্টে দায়িত্ব পালন করেন তামিম ইকবাল। ২০১৮-২০১৯ মৌসুমে ৬টি টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১৭ টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মুমিনুল হক।