হাসান মাহমুদ
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে সাইডবেঞ্চে বসে ছিলেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চলমান সিরিজেরও প্রথম ওয়ানডেতে একাদশে জায়গা হয়নি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে একাদশে ফিরলেও বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় আর বোলিং করার সুযোগ হয়নি। তাই যেন অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই আগুন ঝরালেন প্রথম সুযোগেই। বৃহস্পতিবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যে কোনো পর্যায়ের স্বীকৃত ক্রিকেটে নিজের সেরা বোলিং পারফর্ম্যান্স উপহার দিলেন ডানহাতি পেসার হাসান মাহমুদ।
পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্রথমবার এই ২৩ বছর বয়সী তরুণ নিয়েছেন ৫ উইকেট। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে তিনি ৮.১ ওভার বোলিং করে ১ মেডেনে মাত্র ৩২ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। আর এতেই বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের সর্বনি¤œ সংগ্রহে গুটিয়ে গেছে আইরিশরা।
এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) টি২০ আসরে ১৪ ম্যাচ খেলে যৌথভাবে সর্বাধিক ১৭ উইকেট শিকার করেন হাসান। স্বীকৃত টি২০ ক্যারিয়ারে ৪৯ ম্যাচ খেলেছেন, এবারই প্রথম ৪ উইকেট নেন এক ম্যাচে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ৩ বার ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি ১৫ ম্যাচ খেলে। আর লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ৩৩ ম্যাচ খেলে একবারও ৪ উইকেট পর্যন্ত নিতে পারেননি।
তবে এবার বিপিএল পারফর্ম্যান্স যেন নতুন করে তাকে চেনাতে শুরু করে। দারুণ গতির সঙ্গে ভালো লাইন-লেংন্থের কারণে ২০২০ সালেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে হাসানের। মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক টি২০ ম্যাচে ৪ ওভারে ২৫ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন। সে বছর পাকিস্তান সফরের টেস্ট দলেও ছিলেন তিনি। এর এক বছর পর মিরপুরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় তার।
সেদিন দুর্দান্ত বোলিং করে ৬ ওভারে মাত্র ২৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে ইনজুরির কারণে দীর্ঘ সময় তাকে দলের বাইরে থাকতে হয়েছে। সেই ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন হাসান। এবার বিপিএল দিয়েই যেন আবার নতুন করে স্বরূপে ফেরার ইঙ্গিত দেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজে বেশ ভালো করেছেন। তবে ওয়ানডে সিরিজে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি।
অথচ বিপিএলের আগে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে গত ডিসেম্বরে সর্বশেষ যে ওয়ানডে খেলেন সেই ম্যাচে ৭ ওভারে ৪০ রান দিয়েছিলেন। এ কারণেই হয়তো তাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। এবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ঘোষিত ওয়ানডে দলে থাকলেও সুযোগ মিলছিল না তার। অবশেষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সুযোগ পেলেও বৃষ্টিতে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় কোনো বলই ছোঁড়ার সুযোগ হয়নি হাসানের।
তাই অপেক্ষা বেড়েছে ওয়ানডেতে বোলিংয়ে ফেরার জন্য। বৃহস্পতিবার সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন হাসান। এর জন্যই যেন প্রতীক্ষায় ছিলেন এ তরুণ। আইরিশ ব্যাটাররা রীতিমতো প্রকম্পিত হয়েছেন তার পেসের সামনে। ইনিংসের প্রথম ওভারেই বোলিংয়ে এসে মাত্র ৩ রান দেওয়া হাসান পরের ওভার দেন মেডেন। তার ও তাসকিন আহমেদের ডানহাতি পেসে চাপে পড়া আইরিশদের প্রথম ধাক্কাটা দেন হাসানই। পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে স্টিফেন ডোহেনি তাকে বাউন্ডারি হাঁকান। এদিন সেটাই প্রথম বাউন্ডারি হজম হাসানের।
পরের বলটি ডট দিয়ে তৃতীয় বলেই প্রতিশোধ নেন তিনি। ২১ বলে ৮ রান করা ডোহেনি কট বিহাইন্ড হন। একটানা বোলিং চালিয়ে গেছেন হাসান। নবম ওভারে জোড়া আঘাতে কাঁপিয়ে তোলেন আইরিশ ব্যাটারদের প্রতিরোধ। অভিজ্ঞ পল স্টার্লিংকে (১২ বলে ৭) ওই ওভারের প্রথম বলে এলবিডব্লিউ করে চতুর্থ বলে হ্যারি টেক্টরকেও (০) একই ফাঁদে ফেলেছেন। আইরিশ টপঅর্ডারে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হাসান তাদের প্রথম ৩টি উইকেটই শিকার করেন। ইনিংসের ১১তম ওভারে নিজের ষষ্ঠ ওভার করেন তিনি। একটানা ৬ ওভার বোলিংয়ে ১ মেডেনসহ ২৩ রানে ৩ উইকেট নিয়ে প্রথম স্পেল শেষ করেন হাসান।
এরপর ফিরেছেন ২৫তম ওভারে। ততক্ষণে ৮ উইকেট হারিয়েছে আইরিশরা। ২৫তম ওভারে ৫ রান দেন হাসান। তবে ২৭তম ওভারেই দুর্দান্ত খেলতে থাকা কার্টিস ক্যাম্ফারকে শিকার করে সফরকারীদের ইনিংসে আরেকবার ক্ষতিসাধন করেন তিনি। আর ২৯তম ওভারে এসেও বিপর্যস্ত আইরিশদের শেষ আঘাতটিও দিয়েছেন হাসান। ফিরে গেছেন গ্রাহাম হিউম (৩) এলবিডব্লিউ হয়ে।
এদিন মোট ৪৯টি বল করেছেন হাসান (অর্থাৎ ৮.১ ওভার)। ৩৫টি ডটের মধ্যে এক ওভার আছে মেডেন। ১টি ওয়াইড বল করার পাশাপাশি ৫টি চার হজম করেছেন। ওভারপ্রতি ৩.৯১ হারে ৩২ রানে নিয়েছেন ৫ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২১ রানে ৪ উইকেট ছিল এতদিন তার যে কোনো পর্যায়ের স্বীকৃত ক্রিকেটে সেরা বোলিং।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩ বার এবং স্বীকৃত টি২০তে ১ বার ৪ উইকেট নিলেও ৫০ ওভারের ক্রিকেটে কখনোই ৪ উইকেট নিতে পারেননি। আগের ৭টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে তার মাত্র ৮ উইকেট ছিল। সেরা বোলিং অভিষেক ওয়ানডেতে ২০২১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিরপুরে ২৮ রানে ৩ উইকেট। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে এ নিয়ে বাংলাদেশের ১৩ বোলার ম্যাচে ৫ উইকেট নিলেন। বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান ৫ বার এবং সাকিব আল হাসান ও আব্দুর রাজ্জাক ৪ বার করে ৫ উইকেট নিয়েছেন।
এছাড়া তাসকিন ২ বার ৫ উইকেটের দেখা পেয়েছেন। বাকিরা ১ বার করে এই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন। তবে বাংলাদেশের নবম পেসার হিসেবে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিলেন হাসান। সবমিলিয়ে ২৪টি ঘটনা বাংলাদেশের বোলারদের ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নেওয়ার। এর মধ্যে ১৪টি ঘটনাই পেসারদের। বাংলাদেশের কোনো পেসার হিসেবে সর্বশেষ এই কৃতিত্ব দেখান তাসকিন। গত বছর মার্চে সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৫ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি। এবার হাসানও শিকার করলেন ৫ উইকেট।