ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০

ছাদখোলা বাসে সাবিনাদের বিমানবন্দর থেকে নেয়া হয় বাফুফে ভবন

রাজসিক সংবর্ধনা

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২; আপডেট: ২৩:১৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

রাজসিক সংবর্ধনা

বিমানবন্দর থেকে ছাদখোলা বাসে মতিঝিল ফুটবল ভবনে যাচ্ছেন সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবলাররা

এ এক অন্যরকম আবেগ, অন্যরকম ভালবাসা, অন্যরকম শিহরণ। পুরো বাংলাদেশ নিমিষেই এক বিন্দুতে মিশে গেছে। সবার মুখে একটিই স্লোগান, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ।’ বুধবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ গোটা রাজধানী এমন ভালবাসার স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান গোটা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচের আপামর জনতা। সবার মুখে ঐক্য আর ভালবাসার একই সুর প্রতিফলিত হয়েছে। এভাবেই উৎসবমুখর পরিবেশে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেন বাংলার বাঘিনীরা। সেই থেকে বাংলার ঘরে ঘরে চলছে উৎসব আনন্দ। তখন থেকেই বিজয়ী অগ্নিকন্যাদের বরণ করে নিতে উন্মুখ হয়ে ছিল গোটা দেশ। অবশেষে বুকভরা ভালবাসায় বাংলার চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বরণ করে নেয়া হয়েছে। বুধবার ফুলেল ভালবাসা, রাজকীয় সংবর্ধনাসহ নানা আয়োজনে সাবিনাদের বরণ করে নেন দেশবাসী।
ইতিহাস গড়া সাবিনা-স্বপ্না-সানজিদাদের বহনকারী বিশেষ বিমান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে। বিমানবন্দরে বিজয়ী কন্যাদের স্বাগত জানান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। এ সময় আরও ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক, সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগসহ অন্য কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরুতেই কেক কাটা হয়।

ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী প্রথমেই কেক তুলে দেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের মুখে। এবারের সাফে বাংলার অধিনায়ক ছিলেন দুরন্ত, দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য। পুরো আসরে চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেন। দুটি হ্যাটট্রিকসহ করেন সর্বোচ্চ ৮ গোল। অনুমিতভাবেই সাবিনা জিতে নিয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। এ সময় সফল কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের মুখেও কেক তুলে দেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। এরপর ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী একে একে দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন।
বাংলার সোনার মেয়েদের বরণ করে নিতে সকাল থেকেই বিমানবন্দরের বাইরে হাজার হাজার জনতা ভিড় জমান। তারা সবাই ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ সেøাগানে মুখর করেন চারপাশ। এ সময় অনেকের হাতেই জাতীয় পতাকা, নানা রকম ব্যানার, প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। বিকেএসপির একটি বড় দলও দেখা যায় মেয়েদেরকে বরণ করে নিতে। মেয়েদের অবিশ্বাস্য অর্জনে পুরো বাংলাদেশের মতো গোটা ক্রীড়াঙ্গনও একাট্টা হয়ে গেছে। যার প্রমাণ মিলেছে এ সংবর্ধনায়। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় মেয়েদের বরণ করে নিতে জড়ো হয়েছিলেন অন্যান্য ক্রীড়া ইভেন্টের তারকা ও কর্মকর্তারা। সবার মনের কোণেই ছুঁয়ে গেছে অনাবিল আনন্দ।
বাংলার অদম্য মেয়েদের বরণ করে নিতে সংবাদকর্মীদেরও ছিল উপচেপড়া ভিড়। বেশিরভাগের মতে, বাংলাদেশের যে কোন ক্রীড়া ইভেন্টে এর চেয়ে বেশি সংবাদকর্মী আর কখনও একসঙ্গে জড়ো হননি। দুপুর থেকে দেশের বেশিরভাগ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে মেয়েদের বিজয় প্যারেড। একটানা এতটা গুরুত্ব দিয়ে দেশের আর কোন ক্রীড়া ইভেন্টের গৌরবগাথা সরাসরি সম্প্রচারের নজির নেই। নজিরবিহীন বীরত্বগাথার কারণে মেয়েদের নিয়ে সবার হৃদয়েই চলছে আনন্দের ফল্গুধারা। মিডিয়াকর্মীরাও এর বাইরে নন। যে কারণে চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা বিমানবন্দরে পৌঁছার পর রীতিমতো হুলস্থ’ূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। শতশত সংবাদকর্মী-ইউটিউবাররা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বাঘিনীদের ওপর। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, পা ফেলানোর জায়গাটুকুও মিলছি না। এক পর্যায়ে বেশ বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়।
তবে শেষ মুহূর্তে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য করা হয় সংবাদ সম্মেলন। এটা করা হয় বিশেষ ছাদখোলা বাসে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে। এরপর বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে মেয়েরা ছাদখোলা বাসে ওঠেন। তারপর শুরু হয় মতিঝিলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) উদ্দেশে যাত্রা। চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সেরা তারকা সানজিদা আক্তারের আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর মাত্র একদিনের ব্যবধানে বিআরটিসির দোতলা বাসকে ‘ছাদখোলা’ বাসে রূপান্তরিত করা হয়। বাসের ব্যানারে লেখা ‘চ্যাম্পিয়নস’। এই বাসেই আরোহণ করেন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নরা।

তবে বিমানবন্দর ও বাসে বেশ অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হতে হয় সাবিনাদের। প্রথমত বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় মানুষের ভিড় ও ধাক্কাধাক্কিতে হয় চরম ভোগান্তি। এরপর একই অবস্থা হয় ছাদখোলা বাসের চ্যাম্পিয়ন প্যারেডেও। নারী ফুটবলারদের বহনকারী ছাদখোলা বাসের জন্য দেয়া হয়নি কোন বিশেষ প্রটোকল। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পথে বারবার যানজটের কারণে থেমে যায় বাস। অবশ্য ঢাকা শহরের চিরাচরিত যানজট ঠেলে গন্তব্যে গেলেও কারও মুখে ছিল না ক্লান্তির ছাপ। সবার মুখেই দেখা মিলেছে হাসি, কেউ কেউ নিজের মোবাইল ফোনে লাইভ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তাদের অভিবাদন জানাতে রাস্তার দুই ধারেই ছবি, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী। যে যেভাবে পারেন হাত নাড়িয়ে, গলা ফাটিয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন গর্বিত মেয়েদের। রাস্তার দু’পাশে অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ির ছাদ থেকেও হাত উঁচিয়ে, পতাকা নেড়ে মেয়েদের অভিনন্দন জানাতে দেখা গেছে। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল আসার পথে পুরো রাস্তা ছেয়ে যায় ফুলের সৌরভে। সাধারণ মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার জবাব দিতে ভুল করেননি বাংলার দামাল মেয়েরা। তারা ট্রফি উঁচিয়ে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অভিনন্দনের জবাব দিয়েছেন। বাংলার সবুজ জমিনে ট্রফি নিয়ে ফিরতে পেরে উচ্ছ্বাস থামছেই না তাদের। ফাইনালে জোড়া গোল করে হিরো বনে যাওয়া তারকা কৃষ্ণা রানী সরকার বলেন, ‘বাংলার বাতাস গায়ে লেগেছে অনেকদিন পর। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করার নয়। সবাইকে ধন্যবাদ এত এত ভালবাসা দেয়ার জন্য।’ বাংলার মধ্যমাঠের অন্যতম সেরা তারকা মারিয়া মান্দা বলেন, ‘হ্যালো বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি। তোমার বুকে ট্রফি নিয়ে আসতে পেরে আমরা ধন্য, গর্বিত’।
ছাদখোলা বাসে চরম অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হন বাংলার বাঘিনী ঋতুপর্ণা চাকমা। বিলবোর্ডে মাথা লেগে আহত হন তিনি। অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে হোটেল র‌্যাডিসনের সামনে।

ওই সময় ঋতুপর্ণা  মোবাইল দিয়ে নিজেদের বিজয় উদ্যাপন লাইভ করছিলেন। হোটেলের সামনেই বাস একেবারে রাস্তার আইল্যান্ডের কিনারায় চলে যায়। যেখানে ঝুলানো বিলবোর্ডের কোনায় লেগে মাথার কিছু অংশ কেটে যায়। নারী দলের ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু জানিয়েছেন, খুব বেশি সমস্যা হয়নি ঋতুপর্ণার। কপালে তিনটি সেলাই দেয়া হয়েছে। অপ্রত্যাশিত এ ঘটনায় অবশ্য উদ্দাম উদ্যাপনে ভাটা পড়েনি। হাজার হাজার জনতার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বিমানবন্দর থেকে কাকলি হয়ে মহাখালী ফ্লাইওভার, জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজয় সরণি, তেজগাঁও, ফ্লাইওভার দিয়ে মগবাজার, মৌচাক, কাকরাইল, ফকিরাপুল, আরামবাগ ও মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে বাফুফে ভবনে গিয়ে অবতরণ করে চ্যাম্পিয়ন বীরদের বহনকারী ছাদখোলা বাস।
সেখানে সাবিনা-সানজিদাদের বরণ করে নেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের সভাপতি কিংবদন্তি ফুটবলার কাজী মোঃ সালাউদ্দিন। প্রিয় প্রাঙ্গণে পৌঁছার পর আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মেয়েরা। সেখানে এক পর্যায়ে তাদের চোখে আনন্দাশ্রুও দেখা যায়। এমন অশ্রুর কারণও আছে। কেননা এই বাফুফে ভবনেই গত আট/দশ বছর একসঙ্গে আছেন মেয়েরা। সেখানে একটি পরিবারের মতো থেকে নিজেদের গড়েছেন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে দেশের ফুটবলের কল্যাণে নিজেদের সর্বক্ষণ নিয়োজিত রেখেছেন। যার সোনার ফল এসেছে আজ। জাতি পেয়েছে ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা সাফল্য। তাইতো বীরকন্যাদের নিয়ে পুরো জাতি মেতে উঠেছে উৎসব-আনন্দে।

চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বরণ করে নিয়ে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বলেন, ‘মেয়েরা শিরোপা জিতেছে। যখনই আমাদের ভাল ফল হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের চাইতে হয় না, যেতে হয় না। উনি নিজে পরিকল্পনা করে আমাদের নির্দেশনা দিয়ে দেন। ইতোমধ্যে উনি জানেন যে বাংলাদেশ এমন অর্জন করেছে। আশা করছি, ওখান থেকে ভাল সংবর্ধনা ও উপহার আসবে। আর এখন আমাদের টার্গেট এশিয়া পর্যায়ে ভাল করা।’ এর আগে বিমানবন্দরে প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ও কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে গর্বিত লাল-সবুজের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন শিরোপা দেশবাসীকে উৎসর্গ করেন।

তাদের এভাবে বরণ করে নেয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাল-সবুজের অধিনায়ক বলেন, ‘আমাদের এত সুন্দরভাবে বরণ করে নেয়ার জন্য অসংখ্য, অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা অনেক কৃতজ্ঞ ও গর্বিত। বাংলাদেশের মেয়েদের, বাংলাদেশের ফুটবল যে আপনারা এত ভালবাসেন, এসব দেখে আমরা অনেক অনেক গর্বিত। সবাইকে ধন্যবাদ, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বলুন বা ১৮ কোটি কিংবা ২০ কোটি, এই ট্রফি বাংলাদেশের সব মানুষের।’
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নারী ফুটবলারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে আসা কোচ ও এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগর গোলাম রব্বানী ছোটনও মুগ্ধ দেশে ফিরে এমন সংবর্ধনা পেয়ে। তিনি বলেন, ‘রাজসিক এই আয়োজনে আমাদের বরণ করে নেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের এই পথচলা অনেক দিনের। অনেক পেছন থেকে আমরা উঠে এসেছি। ২০১২ সাল থেকে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল। সবার অবদানেই আজকের এই সাফল্য। এজন্য প্রধানমন্ত্রী, দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।’
ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা ও উৎসবমুখর আয়োজন। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিজয়ী ক্রিকেট দল ও ২০২০ সালে অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ বিজয়ী দলকেও দেয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। কিন্তু এবার মেয়েদের সাফ জয়ের সংবর্ধনা ও উৎসব অতীতের যে কোন কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা ও সবচেয়ে বেশি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন সাবিনা-সানজিদা-মারিয়া-স্বপ্নারা।