রুমেল খান ॥ খুলনার ছেলে তিনি। বাগালির কয়রাতে তার গ্রামের বাড়ি। চাকরিজীবী বাবা আব্দুল গফুর সানা এবং গৃহিণী মা বিউটি বেগমের ২ ছেলে, ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। জন্ম ৮ জুন, ১৯৯৫ সালে। তার মূল পরিচয় তিনি একজন তীরন্দাজ। তীরবাজির পাশাপাশি বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও চাকরি করেন (খেলোয়াড়ী কোটায়)। বিশ্ব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এতগুলো ‘ক্লু’ দেয়ার পর সচেতন পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন আমি কার কথা বলছি। হ্যাঁ, তারকা আরচার রোমান সানা।
এশিয়া আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছেন রোমান। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে রিকার্ভ পুরুষ একক, পুরুষ দলগত ও মিশ্র দলগত ইভেন্টে তিনটি স্বর্ণপদক জিতেছেন বাংলাদেশের সেরা এই তীরন্দাজ। এরই পুরস্কারস্বরূপ বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি বাহিনী তাদের কৃতী এই ক্রীড়াবিদকে সৈনিক থেকে ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি দিয়েছে।
মঙ্গলবার খিলগাঁও আনসার ও ভিডিপি’র সদর দফতরে রোমানকে ল্যান্স নায়েকের ব্যাজ পরিয়ে দেন আনসার ও ভিডিপি’র মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ। এ সময় বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) সহ-সভাপতি ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভানেত্রী মাহবুব আরা গিনি এমপি, আনসার ও ভিডিপি’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম আসিফ ইকবাল, পরিচালক (ক্রীড়া ও সংস্কৃতি) নুরুল হাসান ফরিদী, উপ-পরিচালক (ক্রীড়া ও সংস্কৃতি) রায়হানউদ্দিন ফকির, বিওএ’র উপ-মহাসচিব আশিকুর রহমান মিকু ও আসাদুজ্জামান কোহিনুরসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নেপালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে আনসার ও ভিডিপি’র ১৪৪ ক্রীড়াবিদ বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে অংশ নেন। যার মধ্যে একক ও দলগত ৮ স্বর্ণ, ১৩ রৌপ্য ও ৪৭ তাম্রপদক জেতেন। পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের ৩৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার প্রাইজমানি দেয়া হয়। একক ইভেন্টের সোনাজয়ীদের এক লাখ, রুপাজয়ীদের ৭৫ হাজার এবং ব্রোঞ্জপদক জয়ীদের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পান রোমান সানা।
প্রাইজমানি পেয়ে আনন্দিত রোমান সানা বলেন, ‘আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই প্রাইজমানি অনেক প্রেরণার ও প্রয়োজনীয়। এখন থেকে আমি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পেয়ে ভাল বেতন পাব। এই দিয়ে আমার মাকে আরও ভাল চিকিৎসা করাতে পারব, একটা বাড়ি বানাব এবং সংসারে দিতে পারব।’ রোমান আরও বলেন, ‘আমি সবার কাছে দোয়া চাই যেন আগামীতে আমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও সাফল্য পেয়ে দেশের পতাকার সম্মান বৃদ্ধি করতে পারি। সামনেই অলিম্পিক। আমাকে সবাই যেভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে তাতে আমি আশাবাদী অলিম্পিকে আমি দেশকে ভাল কিছু উপহার দিতে পারব। আমাকে র্যাঙ্ক দিয়ে পদোন্নতি দেয়ায় আনসারের ডিজি মহোদয়ের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ আনসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোমানের ভাষ্য, ‘আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে আনসার। তারা আমাকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে তাতে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। তারা যদি আমাকে সাহায্য করা অব্যাহত রাখেন তাহলে আমার পথচলাটা অনেক সহজ হবে। বিনিময়ে আমিও আশাকরি তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারব।’
অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিয়ে রোমান বলেন, ‘এক বছর ধরেই অলিম্পিকে অংশ নেয়ার জন্য কঠোর অনুশীলন করছি। অলিম্পিকের আগে আমার দুটি বিশ্বকাপসহ মোট ছয়টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলব আমি। এগুলো ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত, প্রতি মাসে একটি করে।’ সৈনিক থেকে ল্যান্স নায়েক হওয়াতে রোমান এখন আগের চেয়ে বেশি বেতন পাবেন আনসারের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে সৈনিক র্যাঙ্কধারী আনসারদের কাছ থেকে পদাধিকার বলেই সম্মানও লাভ করবেন। তবে পদোন্নতির কারণে এরজন্য তাকে কোন বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে না। সেক্ষেত্রে আগের মতোই তিনি শুধু আনসারের হয়ে বিভিন্ন ঘরোয়া ও জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নেবেন, এটাই তার কাজ। র্যাঙ্ক প্রসঙ্গে তার ভাবনা, ‘আমার বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, খেলাধুলা ও বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করা সাপেক্ষে আগামীতে আরও ওপরের দিকে উঠতে পারব বলে আশাকরি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে আমি তো মনে করি একদিন সর্বোচ্চ প্লাটুন কমান্ডার হতে পারব।’ আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে বেশ ক’বার বাংলাদেশকে সম্মানিত করায় তীরন্দাজ রোমান সানাকে আমরা ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি দিয়েছি। সামনেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস। ওই গেমসে আনসার ফের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে আশাকরি। যারা পদক জিতবে তাদের জন্যও সংবর্ধনার আয়োজন করা হবে।’ পাঠকের নিশ্চয়ই আগ্রহ হচ্ছে ক্রিকেট জোয়ারে ভেসে না গিয়ে রোমান কেন ও কিভাবে হয়ে উঠলেন এক প্রতিভাবান ধনুর্বিদ। আসলে তিনি ক্রিকেট-ফুটবলই বেশি খেলতেন। ভালই খেলতেন। খুলনার যে স্কুলে পড়তেন নবম শ্রেণীতে (স্কুলের নাম শিশু মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়), সে স্কুলের সহ-সভাপতি হাসান স্যার। ২০০৮ সালের কথা। এক সপ্তাহের জন্য বিকেএসপির একটি যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হবে খুলনায়। হাসান স্যার রোমানকে আরচারি খেলা সম্পর্কে ধারণা দেন এবং ট্রায়াল দিতে উৎসাহিত করেন। তার কথা শুনে ট্রায়াল দেন এবং প্রথমবারেই টিকে যান রোমান। কিন্তু ঝামেলা বাধে এরপর। ট্রায়ালের চূড়ান্তেপর্বে যোগ দেবার আগে বিষয়টি জানতে পেরে রোমানের মা-বাবা বেঁকে বসেন। কিছুতেই তারা ছেলেকে যেতে দেবেন না বিকেএসপিতে। পরে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করানো হয় তাদের। ভাগ্যিস, রাজি হয়েছিলেন। নইলে বাংলাদেশ কি পেত এমন দক্ষ-সফল এক তীরন্দাজকে? ২০১৩ সাল থেকে ক্লাব পর্যায়ে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে খেলা রোমান এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে ৭ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য, ২ তাম্রপদক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৭ স্বর্ণ, ৬ রৌপ্য এবং ২ তাম্রপদক অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালের অলিম্পিকে গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর এবার দ্বিতীয় বাংলাদেশী ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি অলিম্পিক গেমসে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার কৃতিত্ব দেখান রোমান। হল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠে এই আরচার চমকপ্রদ সাফল্য কুড়িয়ে নেন। এর ফলে তিনি অর্জন করেন ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা। ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৬ ... টানা তিন বছর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জেতার কৃতিত্ব আছে সুদর্শন আরচার রোমানের। তার আগে ও পরে এমন কৃতিত্ব আর কোন আরচারের নেই। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০১৫ সালে কিন্তু জাতীয় আরচারির আসর অনুষ্ঠিত হয়নি। হলে হয়তো ওই বছরও সোনা জিততেন সানা। তার আরেকটি কৃতিত্ব হলোÑ ২০১৪ আসরে রোমান ৩৩৫ পয়েন্ট স্কোর করে ভেঙ্গে দেন ইমদাদুল হক মিলনের ২০১০ সালে গড়া ৩৩৩ পয়েন্টের জাতীয় রেকর্ড। তার এই রেকর্ড এখনও অক্ষুণœ। সৈনিক থেকে ল্যান্স নায়েক রোমান সানা আগামী প্লাটুন কমান্ডার হবার পাশাপাশি দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বর্ণসাফল্য এনে দেবেন, দেশের গৌরব আরও বৃদ্ধি করবেন এটাই ক্রীড়ামোদীদের নিগূূঢ় প্রত্যাশা।